তার এ কাজের যে দীর্ঘ সময়, তাতে বস্তি তার মন থেকে সরে যায়। সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত জেরক্স দোকানে কেটে যায় তার। যখন ছুটি হয়, ফেরার সময় মনে পড়ে সে কোথায় থাকে। তখন সে তার বস্তির ঘরে ফেরার জন্য অস্থির। বিশ্রামের জন্য শরীর ও মনের ওপর ফড়িং এসে বসে যেন। আর রাত যত এগিয়ে আসে ততই বস্তির মেয়ে হয়ে ওঠে নীলা। ততই সে সমস্ত ধোঁয়া-ধুলোকালি চেঁচামেচি দুর্গন্ধ সমস্ত কিছুর অপেক্ষায় অস্থির হয়ে পড়ে। যতক্ষণ না পৌঁছচ্ছে ততক্ষণ শান্তি নেই। সারাক্ষণই ট্রেনের জানালায় অস্থিরতার চোখ ছুঁয়ে যায়। সকালে বেরোবার সময় আবার অন্য মন। হয়ে ওঠে নীলার। বস্তি থেকে বেরোবার অস্থিরতা। বেরোবার সময়টাও দ্রুত চলে আসে। সকাল হয়ে উঠলেই বেরোবার সময় নিকট হয়ে ওঠে। আর বেরিয়ে পড়তে পারলে বাঁচেও যেন। নীলা তখন ট্রেনের কামরায় বসা শিক্ষিত ঘরের মেয়ের মতো মন নিয়ে খেলে। বস্তিকে অস্বীকার করে বেরিয়ে আসে।
অথচ ছুটির দিনে, বস্তিতেই থাকতে চায় সে। আর ভোলার কাছে গিয়ে বসতে চায়। ছুটির দিন না কাটার সংকটে ভোলাকেই প্রয়োজনীয় মনে করে সে। এই বস্তি থেকেই ভোলাকে সংগ্রহ করে সে। মেলামেশা করতে আনন্দও পায়। এক্ষেত্রে বাবুর বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার কথা ভাবে না সে। বরং অস্বস্তি। বস্তিতে থাকার ভের এক স্বাধীনতা খুঁজে পায় সে, এক নিজস্বতার পরিতৃপ্তি। ছোট বয়স থেকে বাবুর বাড়িতে থেকে এসেছে সে। বাবুর বাড়ির ভাল পরিবেশে ভাল খাবার-দাবার খেয়ে থাকার পর যখন কাজ ছেড়ে বস্তির বাড়িতে ফিরে আসে, বস্তির এই পরিবেশেই শান্তি খুঁজে পায়। মাঝে মাঝেই চলে আসতে হত। এই রকম বিপরীত যাপন নিয়ে সে বড় হয়েছে। বস্তিকে অস্বীকার করার কিছু নেই নীলার। তার যাপনের নানাকিছুতে জড়িয়ে থাকে। ভাল লাগার মধ্যে মেখে যায়।
ভোলার জন্য আর অন্য কোনও দিনগুলোতে তেমন অস্থিরতা থাকে না। রব্বিারে ছুটি কাটানোর সংকটে ভোলা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। ভোলা ও নীলার ছুটি যেন সমার্থক। এই ঘরে একা একা কী করবে সে? পাশে আর একটা ঘর আছে। ভাইপো ভাইঝিরা ও দিদির দুই ছেলে ও ঘরে ঘুমোচ্ছে বা খেলছে। ওরা এভাবেই থাকতে অভ্যস্ত। হয়ে পড়েছে। ওঘরেই রান্না খাওয়ার আয়োজন। একচিলতে ঘর। বাবুদের বাড়িতে মা দিদি-বৌদি ঠিকে কাজ করে। ফাঁকে ফাঁকে কেউ আসে। ও ঘরেই তখন ফেরে। বাচ্চারা তাদের পর্যায়ক্রমে সঙ্গে পায়। কেউ এসে খেতে দেয়। কেউ স্নান করায়। কেউ এসে ঘুম পাড়ায়। মা চার বাড়ির কাজ করে। বৌদি পাঁচটা বাড়িতে। দিদি চার বাড়িতে কাজ করে। এই বস্তির কাছেই সমস্ত বাড়িগুলো। বাবু দিদিরা বস্তির গা ঘেঁষে রাস্তা দিয়ে রিক্সা করে বাসস্টপে যায়, ফিরে আসে। কোনটা ফ্ল্যাট বাড়ি, কোনটা নিজের বাড়ি, কোনটা ভাড়াবাড়ি। বাড়ির দাদা-বৌদি দুজনেই হয়তো চাকরি করে। ভাল খায়, ভাল কথা বলে। ফোন, মোটর সাইকেল কিংবা নিজস্ব গাড়ি আছে। কোনও বাবু মদ খেয়ে রাতে মাতলামি করে। ঝগড়া চ্যাঁচামেচি হয় খুব। সে সব জীবনের কথা জানে, স্বভাব জানে নীলা। নিয়মনীতি-আদবকায়দা জেনেছে। ওসব বাড়িরই একজন হয়ে থেকেছে। কিন্তু তার থেকে বেরিয়ে এসেই হাঁফ ছেড়েছে। সে বুঝেছে ও জীবন তার নয়। বরং বস্তির হই-চই নানাকিছু সাধারণ মাতামাতিতে বেশি প্রাণচঞ্চল হতে পেরেছে সে।
আর তার বয়সী মেয়েরা বাবুর বাড়িতেই কাজ করে, সে করে জেরক্সের দোকানে চাকরি, তার এই গৌরব নিয়েও বস্তির থেকে আলাদা কিছু নয়। বস্তি থেকে বেরিয়ে পড়লে যদিও অন্যরকম হয়ে যায় মন তার। তা গা থেকে বস্তি মুছে যায়। সেও মুছে ফেলতে চায়। সে স্বপ্নযাপন বা মিথ্যাপন, সেই আনন্দ নিয়ে এখন আজকের এই ছুটির দিনে আনন্দিত হতে পারে না। এমনই গুরুত্বপূর্ণ এই ছুটির দিনটি। এমনই যাপনের সংকট। নীলা সকাল থেকে খুঁজে ফেরে ভোলাকে। ভোলার মাসির ঘরে গিয়ে গিয়ে। খোঁজ নিয়ে আসে। দশটার পর থেকে খোঁজ নিয়ে এসেছে। যখন তার স্নান হয়ে যায়। এবং চুলে গামছা গোঁজা থাকে। সকাল দশটা পর্যন্ত প্রায় দিন ভোলা ঘুমিয়ে থাকে। কেন হাইড রোডের একটা কারখানায় ভোলা নাইটগার্ড দেয়। ভোরের বেলা ফিরে একটু ঘুমোয়। দশটার পর জেগে ওঠে। এদিক ওদিকেই থাকে। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও ভোলার খোঁজ পাওয়া গেল না। সকাল নটার সময়ই বেরিয়ে যায়। কখন ফিরবে, কিছু বলে যায়নি মাসিকে।
সাজতে শুরু করবার আগে একবার ভোলার মাসির ঘরের কাছে যায় নীলা। ও মাসি, ভোলাদা ফিরেছে?
না রে নীলা। খুব দরকার নাকি?
একটু দরকার ছিল।
কতবার খোঁজ নিতে এলি বল, তার মধ্যে ছোঁড়াটা এল কই! ফিরব না বলে যায়নি অথচ।
দুপুরে খায়নি?
না, সেই চা খেয়ে বেরিয়েছে নটার সময়। ভাত ঢেকে রেখেছি।
পেছু ফেরে নীলা, ভোলাদা ফিরলে আমাকে ডাক দেবে মাসি।
ডাকব রে ডাকব।
ঘরে ফিরে নীলার মনে হয় তিনটে বেজে গেল, এখনও ফিরল না তখন খাবার জন্য আর ফিরবে না। বাইরে কিছু খেয়ে নেবে। বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়েছে নিশ্চিত। তারা কোথাও যাবার প্ল্যান করল হয়তো। ভোলা নেই, তাহলে কী করে নীলা! এখন যদি রবিবার ছাড়া অন্যবারের দুপুর হত, তাহলে নীলা জেরক্স মেশিনের সামনে ভাববারও। সময় খুঁজে পেত না। একটার পর একটা কাজ। ভিড়। মেশিনের শব্দ, কথোপকথন, নানা কিছু নিয়ে নিজেকে একটা জায়গায় রেখে দিতে পারত। এখন পারছে না। শুধু ঘর, আর একা সে। চাকরির এই সমস্যা, ছুটি পায় একদিন। বাবুর বাড়ির কাজে ছুটি নেই, এই সমস্যাও ছিল না।