ছফা আরো জানায়, স্থানীয় পুলিশ-এমপি সবার সাথে সুসম্পর্ক থাকার কারণে মহিলাকে ধরা কঠিন ছিলো তার পক্ষে। তারপরও সে যখন মুশকান জুবেরিকে তার বাড়িতে গিয়ে হাসিবের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে, তখন মহিলা তার লোকজন দিয়ে ছফাকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ওরা তার অস্ত্রটা কেড়ে নিয়ে তাকে হত্যা করারও চেষ্টা করে। ঐ বাড়ির একটি ঘরে তাকে বন্দী করে রেখে পুরো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় সেই মহিলা। কিন্তু ভাগ্য ভালো, অল্পের জন্য প্রাণে বেচে গেছে, সেজন্যে সুন্দরপুর থানার ওসি আর ওখানকার এসপি’র কাছে সে কৃতজ্ঞ। তারা সঠিক সময়ে না এলে মারাই যেতো।
ছফাকে এরকম গল্প বলতে হয়েছে বাধ্য হয়েই। কারণ, তার কাছে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, সে বলবে মুশকান জুবেরি মানুষের শরীরের বিশেষ একটি অঙ্গ ভক্ষণ করে নিজের যৌবন দীর্ঘায়িত করে। নির্দিষ্ট সময় পর পর তাকে সেই অঙ্গটি খেতে হয়। এটাতে আসক্ত হয়ে পড়েছে মহিলা। হাসিবসহ আরো কয়েকজন নিখোঁজের ভাগ্যে এমন পরিণতিই ঘটেছে-তারা সবাই মুশকান জুবেরির শিকার। এ কথা শুনে খুব কম মানুষই বিশ্বাস করবে। ভাববে, তদন্তে ব্যর্থ হয়ে, আসামিকে ধরতে না পেরে এমন গালগল্প ফাঁদছে সে। তারচেয়েও বড় কথা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজন সদস্য হিসেবে, পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কোনো ভিক্টিমের পরিণতি নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলা যায় না। মুশকানকে যদি ধরতে পারতো, তার কাছ থেকে জবানবন্দী আদায় করে নিতে পারতো তাহলে নিশ্চিত করে সেটা বলা যেতো। অন্যের জবানবন্দীর উপর ভিত্তি করে এরকম কোনো ধারণা করা ঠিক হবে না।
ছফার কাছে একমাত্র যে প্রমাণটি ছিলো সেটা ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের স্বীকারোক্তি। সেটাও আবার সরাসরি নুরে ছফার কাছে স্বীকার করেননি তিনি, করেছিলেন ডিবির সাবেক ইনভেস্টিগেটর কেএস খানের কাছে। সেই ডাক্তারও ঘটনার পর পর দেশ ছেড়েছেন। ছফা একবার ভেবেছিলো, নিছক সন্দেহ হিসেবেই কথাটা বলবে কিনা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবকে। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছে, ভিক্টিমের নিকটাত্মীয় হিসেবে কথাটা শুনে কী রকম অনুভূতি হতে পারে ভদ্রলোকের।
অনেক চেষ্টা করেও মুশকান জুবেরি আমেরিকার কোথায় ছিলো সেটা বের করতে সক্ষম হয়নি নুরে ছফা। তাছাড়া, আন্দিজের ঐ ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে হাতেগোণা যে কয়জন জীবিত আছে এখনও তাদের খোঁজ করাটাও সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। এদের বেশির ভাগই বয়সের কারণে মারা গেছে। হাতেগোনা যে কয়জন বেঁচে আছে তারা লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের নাগরিক। বর্তমানে কে কোথায় আছে কেউ জানে না। তারপরও কাকতালীয়ভাবে একজনকে পেয়ে গেছিলো ফেসবুকে, কিন্তু ভদ্রলোক আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত। অতো আগের ঘটনা তো দূরের কথা, সকালে নাস্তা করেছে কিনা সেটাই ভুলে বসে থাকে!
আন্দিজের প্লেন ক্র্যাশে বেঁচে যাওয়া যাত্রিদের নিয়ে পিয়ার্স পল রিড যে বইটি লিখেছেন-অ্যালাইভ : দ্য স্টোরি অব দি আন্দিজ সারভাইভার্স-সেটাকে সূত্র হিসেবে ধরেও কিছুটা খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করেছিলো সে। কিন্তু ভদ্রলোক ছফার মেইলের জবাবে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বেঁচে যাওয়া যাত্রিদের মধ্যে যারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছে তাদের ব্যাপারে তিনি কোনো রকম তথ্য দিতে পারবেন না।
“কী ব্যাপার, চা খেলেন না যে?”
নম্রভদ্র কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ একটি কণ্ঠ শুনে ছফা সম্বিত ফিরে পেলো। তাকিয়ে দেখলো প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিব ঘরে ঢুকেছে। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো সে।
ভদ্রলোক নিজের ডেস্কে বসে ছফাকেও বসার জন্য ইশারা করলো। “আপনি বোধহয় একটু আগে চলে এসেছেন?”
“জি, স্যার,” বললো নুরে ছফা। “জ্যামের কারণে দেরি হতে পারে বলে একটু আগেভাগে রওনা দিয়েছিলাম, পরে দেখলাম আজকে তেমন একটা জ্যাম নেই।”
“পিএম অফিস শেষ করলেন একটু আগে,” কথাটা এমনভাবে বললো আশেক মাহমুদ, যেনো জবাবদিহির মতো না শোনায়।
ছফা কোনো কিছু না বলে চুপ করে রইলো।
“কাজকর্ম কেমন চলছে?”
“জি, স্যার…ভালোই।”
“ঐ কেসটার আর কোনো ডেভেলপমেন্ট হয়নি বোধহয়, তাই না?”
গভীর করে দম নিয়ে নিলো ছফা। ব্যর্থতার কথা বলতে তার কখনও ভালো লাগে না, জঘন্য রকমের অনুভূতি তৈরি হয়। আর ক্ষমতাবানদের সামনে ব্যর্থতার কথা বললে নিজেকে কেমন তুচ্ছ, অপাংক্তেয় মনে হয় তার।
“কিন্তু কদিন আগে, পহেলা বৈশাখে সম্ভবত এক ঝলক দেখেছিলাম তাকে।” কথাটা বলার কোনো ইচ্ছে না থাকলেও শেষ পর্যন্ত বলে দিলো ছফা। নিজেকে পুরোপুরি ব্যর্থ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চাইলো না। সে যে এই কেসটা নিয়ে এখনও কতোটা মগ্ন হয়ে আছে, কোটা মরিয়া, এই ক্ষমতাবান মানুষটি জানে না, তাকে জানানো দরকার।
বিস্ময়ে ভুরু কপালে উঠে গেলো আশেক মাহমুদের। “আপনি তাকে দেখেছেন!?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “শাহবাগের দিকে…আমি তখন রিক্সায় ছিলাম…মহিলা একটা প্রাইভেটকারে ছিলো।”
“তারপর?” উৎসুক হয়ে উঠলো পিএস।
“আমি রিক্সায় ছিলাম বলে গাড়িটা ধরতে পারিনি।”
পিএস এখনও উন্মুখ হয়ে আছে বাকি কথাটা শোনার জন্য।
“গাড়ির নাম্বারটা টুকে রাখতে পারিনি উত্তেজনার চোটে।”