.
অধ্যায় ৪
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজন সদস্য হিসেবে প্রায় এক যুগ ধরে কাজ করে গেলেও কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢোকার সৌভাগ্য হয়নি নুরে ছফার।
ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রভূমি এই অফিসটির ছোটোখাটো কর্মচারী থেকে শুরু করে প্রায় সবাই কমবেশি ক্ষমতার দম্ভ আর প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে সবচাইতে ক্ষমতাবান হলো প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিবের পদটি। এটা পেতে মারাত্মক রকমের লবিং করা হয়, মরিয়া হয়ে ওঠে শাসকদলের ভেতরে নানান গোষ্ঠি আর চক্র। যারা এখানে কাজ করার সুযোগ পায় তারা ধরেই নেয়, এটাই তাদের সারা জীবনের সবচাইতে বড় সাফল্য-বিশেষ করে ক্ষমতা আর অর্থোপার্জনকেই জীবনের সবচাইতে বড় সফলতা হিসেবে গণ্য করে যারা।
এ মুহূর্তে নুরে ছফা বসে আছে এরকমই একজন সফল মানুষ, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিবের অফিসে। ভদ্রলোক কী একটা কাজে ব্যস্ত আছে। একজন আরদালি এসে তাকে এক কাপ চা দিয়ে বলে গেছে, আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে, একটু পরই চলে আসবেন পিএস।
ছফা যথেষ্ট অবাক হয়েছে আজকের এই কলটির জন্য। এর আগে, সুন্দরপুর থেকে যখন মুশকান জুবেরিকে ধরতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো তখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর এই ব্যক্তিগত সচিবের সাথে দেখা করেছিলো তার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। ভদ্রলোক তার মুখ থেকেই জানতে চেয়েছিলো তদন্তের কী অবস্থা।
হাসিব নামের এক নিখোঁজ ছেলের মামা, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব কেটার তদন্ত করতে বলেছিলো ডিবিকে নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছিলো, নুরে ছফা যেনো কেসটা দেখে। ফলে ওখান থেকে ফিরে আসার পর তার কাছ থেকেই সবটা শুনতে চেয়েছিলো ভদ্রলোক। তবে ছফা পুরো ঘটনাটা বলেনি। সব কিছু বিবেচনায় নিলে, এটা কাউকে বলাও সম্ভব ছিলো না। তাই সে বলেছিলো, নিখোঁজ হাসিবের শেষ গন্তব্যস্থল ছিলো ঢাকা থেকে বহু দূরে, সুন্দরপুরে অদ্ভুত নামের একটি রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের মালিক মুশকান জুবেরি নামের রহস্যময়ী এক মহিলা। ছফা তদন্ত করে দেখেছে, ফেসবুকে এই মহিলার সাথে হাসিবের পরিচয় হয়েছিলো।
তাহলে ওখানে যাবার পর হাসিব কেন নিখোঁজ হলো?
এমন প্রশ্নের জবাবে ছফা তাকে জানায়, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়, তাই জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছে না। তার কাছে শক্ত কোনো প্রমাণও নেই, হাসিব নামের ছেলেটি কী ভাগ্য বরণ করেছিলো। তবে মুশকান জুবেরির ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে জানা গেছে, দীর্ঘদিন সে আমেরিকায় ছিলো। পেশায় একজন মেডিকেল ডাক্তার। তখন অবশ্য নাম ছিলো মুশকান সোহেলি। অনেকদিন আমেরিকায় থাকার পর দেশে চলে আসে। ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে কাজও করেছে বেশ কিছু দিন। তারপর হুট করেই সেই চাকরি ছেড়ে দেয়। গুজব আছে, অনৈতিক কাজের সাথে মহিলা জড়িত ছিলো। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের সুনাম বজায় রাখার জন্য পুরো ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে দেয়, তাই সত্যিটা বের করা সম্ভব হয়নি।
যাই হোক, ঐ হাসপাতালে কাজ করার সময়ই ক্যান্সারে আক্রান্ত এক রোগীকে বিয়ে করে মহিলা। পঞ্চাশোর্ধ রাশেদ জুবেরি ছিলো উত্তরাঞ্চলের এক জমিদারের একমাত্র বংশধর। ওখানকার বিপুল পরিমাণের স্থাবর সম্পত্তির মালিক ছিলো সে। এভাবে ভদ্রলোকের বিপুল সম্পত্তি করায়ত্ত করে নেয় মহিলা। পেশায় ডাক্তার হলেও মুশকান নামের ঐ মহিলার ঝোঁক ছিলো রান্নাবান্নার দিকে। অসাধারণ একজন কুক। মি. জুবেরি ক্যান্সারে মারা গেলে সুন্দরপুরে রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি নামের অদ্ভুত একটি রেস্টুরেন্ট দেয় সে। তার খাবারের অসাধারণ স্বাদের কারণে ক্রমেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন ছুটে যেতে শুরু করে ওখানে। ফলে, মফশ্বল শহর হলেও ঐ রেস্টুরেন্টের সুবাদে ভোজন রসিকদের কাছে সুন্দরপুর হয়ে ওঠে তীর্থস্থানে।
কিন্তু হাসিবের সাথে মহিলার কী সম্পর্ক ছিলো?-প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদ অধৈর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলো ছফার কাছে।
সে জানিয়েছিলো, সম্ভবত ঐ মহিলার সাথে এক ধরণের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিলো হাসিবের। মহিলা দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
ঠিক আছে, সুন্দরপুরের এক রহস্যময়ী, সুন্দরী, গুণবতী মহিলার সাথে ফেসবুকে হাসিবের ঘনিষ্ঠতা হলো, তারপর একদিন সেখানে গেলো মহিলার সাথে দেখা করতে-কিন্তু ওখানে যাবার পর কী এমন ঘটনা ঘটলো যে, সে নিখোঁজ হয়ে গেলো? তার আসলে কী হয়েছিলো?
আশেক মাহমুদের কাছ থেকে এমন যৌক্তিক প্রশ্ন যে আসবে সেটা আগে থেকেই জানতো নুরে ছফা। জবাবটাও সে প্রস্তুত করে রেখেছিলো। সে জানায়, খোঁজ নিয়ে জেনেছে, শুধু হাসিবই নয়, এই মুশকান জুবেরি আরো তিন-চারজনকে এভাবে ফেসবুকের মাধ্যমে সখ্যতা তৈরি করে সুন্দরপুরে নিয়ে গেছে…তাদের কারোরই আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলো আশেক মাহমুদ-কেন?
ছফা তখন আরেকটি মিথ্যে বলে-অবশ্য এটা সত্যের অনেক কাছাকাছি : তার ধারণা মুশকান জুবেরি অনেকটা সিরিয়াল কিলারদের মতো, তবে পার্থক্য হলো, সে ভিক্টিমের অগ্যানও কালেক্ট করে।
এ কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছিলো পিএস। ফ্যাকাশে হয়ে গেছিলো তার চোখমুখ।