কেমো থেরাপি দেবার কারণে সব চুল পড়ে গেছে। মাথায় পরে আছে। একটা স্কার্ফ। এককালের সুন্দর ভুরুজোড়া এখন প্রায় নেই বললেই চলে। হাড্ডিসার হাতটায় কোনো শক্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও হঠাৎই আবিষ্কার করলো, দুর্বল হাতটা আলতো করে চেপে ধরার চেষ্টা করছে। হয়তো তাগিদ দিচ্ছে তাকে, অনুনয় করছে!
“বুবু,” অবশেষে বলতে পারলো আশেক মাহমুদ। “হাসিব নিখোঁজ হবার পর যখন পুলিশ কিছু বের করতে পারলো না তারপরই আমি ডিবির এক ইনভেস্টিগেটরকে দিয়ে কেসটা তদন্ত করিয়েছিলাম।”
তার বুবু স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, সবটা শোনার জন্য উন্মুখ সে।
“খুবই মেধাবি ইনভেস্টিগেটর সে,” একটু থেমে ঢোঁক গিলল। “ঐ অফিসার আপ্রাণ চেষ্টা করে খুব দ্রুত বের করতে পেরেছিলো হাসিব কোথায় গিয়ে উধাও হয়েছিলো।”
আশেক মাহমুদ টের পেলো তার বুবুর হাত আরো শক্ত করে ধরে আছে তার হাতটা, দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
“ঢাকা থেকে সুন্দরপুর নামের এক মফস্বল শহরে গেছিলো হাসিব,” কথাটা বলে চুপ মেরে গেলে আশেক।
“কেন?” উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো তার শয্যাশায়ী বোন। “ওখানে কেন গিয়েছিলো হাসিব?!”
“একজনের সাথে দেখা করতে।”
“কার সাথে?”
“এক মহিলার সাথে।”
“মহিলা??” বিস্মিত হলো ক্যান্সারের রোগী।
মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক মাহমুদ। “রহস্যময়ী এক মহিলা। খুবই ভালো একজন কুক…অসাধারণ সব খাবার নাকি রান্না করতো।”
“একজন কুকের সাথে দেখা করতে গেছিলো হাসিব?!” অবিশ্বাসের সুরে জানতে চাইলো আশেকের বুবু। যে দুচোখে মৃত্যুর স্থায়ী ছাপ পড়ে গেছে, তাতে এখন অপার বিস্ময়।
“মহিলা ওখানে একটি খাবারের রেস্টুরেন্ট দিয়েছিলো…খুবই সুস্বাদু খাবার পাওয়া যেত…হাসিব ওখানেই গেছিলো শেষবার। শুধু এটুকুই জানা গেছে।”
“তুই আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছিস। ঠিক করে বল, ঐ মহিলার সাথে হাসিব কেন দেখা করতে গেছিলো? খাওয়ার জন্য নিশ্চয় সে যায়নি? আর যদি খেতেই গিয়ে থাকে তাহলে ফিরে এলো না কেন!”
আশেক মাহমুদ আলতো করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “আসল সত্যটা ঐ অফিসারও বের করতে পারেনি, তবে তার ধারণা, হাসিবের সাথে ঐ মহিলার পরিচয় হয়েছে ফেসবুকে, তাদের মধ্যে এক ধরণের ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়েছিলো।”
ফেসবুকের কথা শুনে তিক্ততায় মুখ বিকৃত হয়ে উঠলো হাসিবের মায়ের। এই ফালতু জিনিসটা মানুষকে মানুষের কাছে এনে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু কাজ করে ঠিক উল্টোটা। কাছের মানুষদের দূরে সরিয়ে, দূরের মানুষকে কাছে এনে মিথ্যে এক জগত তৈরি করে, আর দিন দিন সেই জগতে বন্দী হয়ে পড়ছে মানুষজন। কানাডায় যখন মেয়ের কাছে ছিলো, দেখেছে, তার টিনএজার নাতি-নাতনিরা সারাদিন ডুবে থাকে এই ফেসবুক নিয়ে, নানির খোঁজ নেবারও সময় পেতো না। কিন্তু যেদিন অসুস্থ নানির সাথে সেল্ফি তুলে তার নাতি-নাতনিরা ফেসবুকে পোস্ট দিলো ‘প্রে ফর মাই গ্র্যান্ডমাদার,’ সেদিনই আর্জুমান্দ বেগম বুঝে গেছিলো, পৃথিবীটা আসলেই রসাতলে তলিয়ে গেছে।
গভীর করে দম নিয়ে বললো বৃদ্ধা, “ঠিক আছে, হাসিব ঐ মহিলার সাথে দেখা করতে গেছিলো…এর সাথে তার নিখোঁজের কী সম্পর্ক? কী এমন ঘটনা ঘটেছে…ওখানে গিয়ে সে আর ফিরে এলো না?”
বুবুর দিকে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদ। তারপরই মিথ্যেটা বললো, “সেটা তো জানা যায়নি, তবে ঐ অফিসার মনে করছে, মহিলা কোনো চক্রের সাথে জড়িত।”
“কীসের চক্র?”
বলতে একটু ইতস্তত করলো আশেক। “মহিলা এক সময় ডাক্তার ছিলো, বুবু। পরে কোনো এক কারণে চাকরি ছেড়ে দেয়। বয়সে বড়, এক ধনী লোককে বিয়ে করে অগাধ সম্পত্তির মালিক বনে যায় সে। ঐ লোকের পূর্বপুরুষেরা সুন্দরপুর নামে এক এলাকার জমিদার ছিলো।”
“কিন্তু ঐ মহিলা কেন হাসিবকে…” কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। কারণ কী? কীসের জন্য সে এটা করলো? টাকার জন্য নিশ্চয় এ কাজ করেনি সে?”
মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো আশেক মাহমুদ। “জানি না, বুবু।” বোনের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না সে। যদিও নুরে ছফা তাকে বলেছিলো, মহিলা সম্ভাব্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারকারী দলের সদস্য কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রি বোনকে সে কথা বলা মানেই স্বাভাবিকভাবে তার মনে কিছু ভয়ঙ্কর দৃশ্যকল্প উসকে দেয়া। বিভৎস সেই দৃশ্য। এমন নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে, নিজের সন্তানকে নিয়ে ওরকম কিছু ভাবা নিশ্চয় সুখকর হবে না।
কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কেটে গেলো, তারপর সেই অসহ্য নীরবতা ভাঙলো আশেক মাহমুদ নিজেই। “রহস্যময়ী এক নারী। পেশায় মেডিকেল ডাক্তার।” আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললো পিএস, “আসল নাম মুশকান সোহেলি, বিয়ের পর হয়ে যায় মুশকান জুবেরি। দীর্ঘদিন আমেরিকায় থাকলেও এক সময় দেশে চলে আসে, ঢাকার এক হাসপাতালে চাকরি নেয়। ঐ ইনভেস্টিগেটর আমাকে শুধু এটুকুই জানাতে পেরেছে, বুবু।” পরক্ষনেই পিএস টের পেলো তার বোনের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছে তার হাত। অবাক হয়ে ফিরে তাকালো বোনের দিকে।
আর্জুমান্দ বেগমের নিষ্প্রাণ চোখের মণিদুটো শুধু জ্বল জ্বলই করছে না, দুটো ছোট্ট বিন্দু যেনো অস্থির হয়ে লাফাচ্ছে শূন্যে! রাগে না ক্ষোভে, বুঝতে পারলো না। রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে কঙ্কালসার হাতটি।