এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলে বৃদ্ধার মুখে। “এখনও মরিনি,” বেশ ক্ষীণ আর দুর্বল কণ্ঠে বললো। “তবে আজ সকালে মনে হচ্ছিলো দুপুর পর্যন্ত দুনিয়ার আলো দেখে যেতে পারবো না।”
আশেক মাহমুদ চুপচাপ তার বোনের শিয়রে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। হাউজনার্স মেয়েটি বুঝতে পারছে না তার এখন চলে যাওয়া উচিত কিনা, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে।
“তুমি যাও,” বেশ মৃদু কণ্ঠে নার্সকে বললো রোগী। “রেস্ট নাও।”
মেয়েটা ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আশেক মাহমুদ। “খুব ব্যস্ত ছিলাম, বুবু। পিএম আজকে বিকেল পর্যন্ত অফিস করেছেন…নইলে…”
“বুঝেছি রে!” একটা নিশ্বাস ফেলে বললো বৃদ্ধা। “কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো দুপুরের পর আর…”
আশেক মাহমুদের বলতে ইচ্ছে করছিলো-বুবু, এভাবে বোলো–কিন্তু কিছুই বললো না সে। বড়বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো পরম মমতায়। তার মনে পড়ে যাচ্ছে, ছেলেবেলায় ঠিক এভাবে তার বুবু কতোবারই না তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। তার চেয়ে মাত্র দশ বছরের বড় এই বোন অকালে মাতৃহারা আশেককে সন্তানের মতো কোলেপিঠে মানুষ করেছে। মায়ের সবটা আদর আর ভালোবাসা পেয়েছে। এই বোনের কাছ থেকেই।
“আমি যেকোনো সময় চলে যাবোরে, আশেক!”
বোনের এমন কথায় কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকলো পিএস।
“আমার মন বলছে কাল সকালটা দেখতে পারবো না।”
আশেক মাহমুদের চোখ ছল ছল করে উঠলো। এরকম মুহূর্তে সান্ত্বনা দেয়া, কিছু একটা বলে প্রবোধ দেয়ার মতো স্বভাব কোনো কালেই তার ছিলো না। জোর করে দিতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। সে বরং এমন সময় চুপ করে থাকে। যদিও এ মুহূর্তে তার চোখদুটো অবাধ্য হয়ে উঠেছে, ঠেলেঠুলে বের হয়ে আসতে চাইছে অশ্রু।
“গতরাতে হাসিবকে স্বপ্নে দেখেছি। আমাকে বলছিলো, তুমি আসছো না কেন, মা? এত দেরি হচ্ছে কেন আসতে!”
পিএস নিশ্চুপ রইলো। দেশে ফিরে আসার পর থেকেই তার বুবু এরকম কথা বেশ কয়েকবার বলেছে। কানাডায় থাকার সময় যখন। মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়লো তখন তার মাতৃসম বড়বোন সিদ্ধান্ত নিলো নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই বাকি সময়টা কাটাবে, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে জন্মভূমিতেই।
বোনকে কোনো কিছু বলে সান্ত্বনা দিতে পারছে না বলে নিজের কাছেই লজ্জিত আশেক। রাজনীতির মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কেন যে এসব কায়দা কানুন এখনও শিখতে পারলো না, সেটা ভেবে অবাকই হয় সে।
“ভেবেছিলাম মৃত্যুর আগে হাসিবের কী হয়েছিলো সেটা জেনে যেতে পিরবো,” ক্যান্সারের রোগী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।
সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব।
“আমি জানি আমার ছেলেটা আর বেঁচে নেই,” কথাটা বলে উদাস হয়ে তাকালো হাসিবের মা। “কিন্তু তার কী হয়েছিলো? কে আমার এতো বড় সর্বনাশ করলো…জেনে যেতে পারবো না!” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
এবার আশেকের কিছু বলার পালা কিন্তু গলার কাছে একটা গিট আটকে আছে যেনো।
“তুই আমাকে কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারিরে, বুল্লা!”
ছোটোবেলার আদুরে ডাকটা অনেকদিন পর শুনতে পেয়ে আশেক মাহমুদ প্রবল আবেগে আক্রান্ত হলো, ছলছল চোখে চেয়ে রইলো বোনের দিকে। হাসিবের কী পরিণতি হয়েছে, কে তার জন্য দায়ী সেটা জানার পর পরই সে জানতে পারে তার বোনের শরীরে বাসা বেধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সার। এমনিতেও খবরটা দিতো কিনা সন্দেহ ছিলো তার মনে, তবে ক্যান্সারের সংবাদ শোনার পর আর কোনো দ্বিধা থাকেনি। পুরো ব্যাপারটা চেপে যায় সে। তদন্ত হচ্ছে…কিন্তু কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না তদন্তকারী অফিসার-এমন কথা বলে বোনকে প্রবোধ দিয়েছিলো।
“আমার এই অবস্থায় হয়তো খারাপ খবরটা জানাতে চাসনি,” আশেকের বুবু আস্তে করে বললো। “কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি ধরেই নিয়েছি আমার হাসিব আর নেই।” একটু থেমে দম নিয়ে নিলো মহিলা। “আমি শুধু জানতে চাই, আমার বুকটা কে খালি করেছে। কে এতো বড় সর্বনাশ করলো…কেন করলো!”
আশেক বোনের দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। তার বুবুর দুচোখের কোণ দিয়ে আস্তে করে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। দু-হাতে বোনের হাতটা ধরে নিজের গালে ঠেকালো সে।
“বিশ্বাস কর, বুল্লা…তুই যা ভাবছিস আসলে ঘটনা সেরকম কিছু না।”
কথাটার মানে বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদ। ঢোঁক গিলে কোনোমতে বললো সে, “কী বলছো, বুবু? কীসের ঘটনা?”
“এই যে…হাসিবের খারাপ পরিণতির কথা জানতে পারলে আমি খুবই কষ্ট পাবো।”
মাথা দোলালো পিএস।
“এই কয়েক বছরে প্রতিটি মুহূর্তে মা হিসেবে আমি যে কষ্ট পেয়েছি সেটা কোনো কিছুর সাথে তুলনা করা যাবে না। কষ্ট পেতে পেতে আমি প্রায় অবশ হয়ে গেছি, নতুন করে আর কী কষ্ট পাবো!” একটু দম নিয়ে নিলো বৃদ্ধা। “আসলে কী, জানিস?” ছোটোভায়ের কাছ থেকে কোনো জবাবের অপেক্ষা না করেই বললো, “সত্যিটা না জেনে, অপরাধীকে শাস্তি পেতে না দেখে এই পৃথিবী ছেড়ে যেতেই বরং ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।”
আশেক একটা দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো। মনে হচ্ছে বোনকে অন্তিম মুহূর্তে সবটা বলে দেয়াই ভালো, মা হিসেবে এটা জানার অধিকার সে রাখে। আবার একইসাথে এটাও মনে হচ্ছে, খবরটা জানতে পারলে এই শেষ সুময়ে, ক্যান্সারের ছোবলে যখন যন্ত্রণাকাতর সময় পার করছে তখন তার কষ্ট বাড়িয়ে দেবার কোনো মানেই হয় না।