হয়তো তার এমন পণ করার কারণও আছে। আজ সকালে একটা ফোন পাবার পর থেকে নিজের ভাগ্নের কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছিলো বার বার। নিরীহ আর দ্র একটা ছেলে, অথচ তাকেই কিনা বরণ করে নিতে হলো নির্মম পরিণতি! তার মতো ক্ষমতাবান মামা থাকতেও নিরাপরাধ ভাগ্নের অন্তর্ধান রহস্য বের করে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয়নি। আর এদিকে, এক শিল্পপতির লম্পট ভাগ্নে ধর্ষণ-খুন করেও পার পেয়ে যাবে টাকার জোরে!
যাই হোক, প্রত্যাখ্যাত হয়ে শিল্পপতি মামা ‘ক্ষমতায় গেলে মানুষ কিভাবে বদলে যায়’ বহুল ব্যবহৃত সেই আপ্তবাক্য ঝেড়ে দু-কথা শুনিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলো টেলিফোনে। দুমুখ হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি আছে এই লোকের। তার ‘বিখ্যাত’ ব্যবহারের কথাও সবার জানা। কিন্তু আশেক মাহমুদের বসবাস ক্ষমতার পিরামিডের একদম শীর্ষবিন্দুর কাছে। এরকম একজনকে তোয়াক্কা না করলেও সে পারে। লোকটার ইতিহাসও তার ভালো করেই জানা আছে-গণ্ডগ্রামের এক বেয়াড়া যুবক, অতীষ্ঠ করে তুলেছিলো গ্রামের লোকজনের জীবন। শেষে, গ্রামের মসজিদে বসা এক সালিশে জুতাপেটার মতো অবমাননাকর শাস্তি দেয়া হয় তাকে। ঐ ঘটনার রাতেই, প্রতিশোধ হিসেবে মসজিদের দানবাক্স ভেঙে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে চলে আসে ঢাকা শহরে।
আজব এক শহর ঢাকা। হাজার হাজার গলি ঘুপচি এখানে-সবগুলো দৃশ্যমান নয় সবার কাছে। কোটা দিয়ে ঢুকলে টাকার খনির সন্ধান পাওয়া যাবে সেটা জানা থাকলে এখানে ‘বড়লোক হওয়া দুনিয়ার সবচেয়ে সহজতম কাজ। পৃথিবীর আর কোথাও মসজিদের দানবাক্স চুরি করা পুঁজি দিয়ে কোনো লোক মাত্র দশ বছরে শিল্পপতি হতে পেরেছে কিনা আশেক মাহমুদের জানা নেই।
যাই হোক, লোকটার অতীত নিয়ে তীর্যক কথা বলেই শুরু করেছিলো সে। তারপর ঢাকা ক্লাবে জুয়া খেলা, মদের আড্ডায় বেসামাল হয়ে পড়া আর নিত্যনতুন নারীসঙ্গের কথাও বাদ দেয়নি। ফোনালাপটি শেষ করেছিলো এই বলে : “আমি যততদিন আছি, আপনি কিভাবে পিএমের অফিসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান দেখে নেবো। দেখি, কী বালটা ফেলতে পারেন!”
বলাবাহুল্য, মসজিদের টাকা চুরি করা চোরটা আর কথা বাড়ায়নি। আশেক জানে, বদমাশটা এখন ভাগ্নেকে বাঁচানোর জন্য সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। ওই রাস্তাটাও সে বন্ধ করে দিয়েছে জায়গামতো ফোন করে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। চোখের সামনে জন্ম নেয়া তার নিজের ভাগ্নে হাসিবের কথা ভাবলো। অফুরন্ত সম্ভাবনা ছিলো ছেলেটার। চুপচাপ, শান্তশিষ্ট। কারো সাতে-পাঁচে নেই। ইউরোপ আমেরিকায় বসবাস করার সুযোগ পেয়েও দেশে থেকে গেছিলো কীসের টানে কে জানে! নিজের মতোই থাকতো। স্বাবলম্বী আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটি ছেলে। ক্ষমতাবান মামার কাছেও কোনোদিন কিছু চায়নি, কোনো তদবির নিয়ে আসেনি কখনও। এরকম নম্ৰদ্র আর নির্বিবাদি ছেলেরও যে শত্রু থাকতে পারে, কে জানতো!
গাড়িটা গুলশান দুই নাম্বারে ঢুকতেই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলো প্রধানমন্ত্রীর পিএস। আর মাত্র কয়েক মিনিট পরই বিব্রতকর একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তাকে।
.
অধ্যায় ৩
হাড্ডিসার বয়স্ক যে বৃদ্ধা বিছানায় শুয়ে আছে তার চোখে মৃত্যুর ছায়া সুস্পষ্ট।
পাশে বসে থাকা হাউজনার্স মেয়েটি আরো একবার হাই তুললো। মেয়েলী কোনো ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছে সে। সারা রাত জেগে থেকে এই রোগীর কষ্ট-যন্ত্রণা উপশম করার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিতে হয় তাকে। মোবাইলফোন বের করে ফেসবুকে ঢু মারতে ইচ্ছে করলেও উপায় নেই-এই রোগী এটা বরদাশত করতে পারে না। কয়েক দিন আগে মহিলা ঘুমিয়ে পড়লে সে ফোন বের করে ফেসবুকে লগিং করতে গেছিলো, আর অমনি চোখ খুলে ফেলে রোগী। দুর্বল গলায় কিন্তু কঠিন স্বরে বলে দেয়, তার সামনে যেনো কখনও এ কাজ না করে। এমন কি, এ ঘটনার পর তাকে টিটকারি মেরে ফেবুন্নেসা নামেও ডেকেছিলো কয়েকটা দিন। সম্ভবত, অজানা কোনো কারণে ফেসবুক জিনিসটা সহ্যই করতে পারে না বুড়ি।
মহিলার ঘুম একদম পাতলা। এই পর্যায়ে এসে ঘুম বলে কিছু নেই আর তার মধ্যে। চোখে আই মাস্ক পরে নিথর দেহটা নিয়ে পড়ে থাকে, সম্ভবত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। একটু আগে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টানোর শব্দেও একবার নড়েচড়ে উঠেছিলো তবে কিছু বলেনি, আবারও স্থির হয়ে গেছে।
হঠাৎ পারফিউমের গন্ধ টের পেয়ে হাউজ নার্স জেবুন্নেসা ফিরে তাকালো দরজার দিকে, সঙ্গে সঙ্গে ম্যাগাজিনটা রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। তার নিয়োগকর্তা, এ বাড়ির মালিক দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
“স্যার–”
হাত তুলে মেয়েটাকে থামিয়ে দিলো আশেক মাহমুদ, তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে এলো বিছানার কাছে। “কখন ঘুমিয়েছে?” একেবারে ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো সে।
“এই তো–” মেয়েটা নীচুকণ্ঠে জবাব দিতে গিয়ে থমকে গেলো।
“আমি ঘুমাইনি,” বৃদ্ধা বলে উঠলো ঘরের দু-জনকে অবাক করে দিয়ে। “আমার কি আর ঘুম আসে!” চোখ থেকে আই-মাস্কটা কপালের উপর তুলে দিলো রোগী।
বোনের দিকে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদ। তার ইচ্ছে করছে চোখ সরিয়ে ফেলতে, এককালের রূপবতি বড়বোনের এমন করুণ অবস্থা দেখতে চায় না।
“বুবু, কেমন আছো?” প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলো ভুল হয়ে গেছে। মৃত্যুপথযাত্রি কাউকে এ প্রশ্ন করা অনেকটা তামাশার মতোই শোনায়।