শাহবাগের মোড়ে, পিজি হাসপাতালের সামনে এসে একটা রিক্সা পেয়ে গেলে উঠে বসলো তাতে। বেতার ভবনের সামনে দিয়ে এগোতে শুরু করলো রিক্সাওয়ালা। প্রচুর যানবাহনের কারণে রিক্সার গতি শ্লথ। কিছু দূর যাবার পর একটা রিংটোন বেজে উঠলে অবাক হলো সে। তার ফোন সব সময় সাইলেন্ট থাকে, আজকেও তা-ই আছে। রিক্সাওয়ালা প্যাডেল মারার গতি কমিয়ে দিয়ে কোমর থেকে সস্তা একটি চায়নিজ মোবাইলফোন বের করলে মুচকি হাসলো ছফা। মোবাইলফোন নেই এমন লোকজন আর চোখে পড়ে না আজকাল।
“মুক্তাররে কইবেন আমি সামনের হপ্তায় বাড়ি আইতাছি…ওর সব ত্যাজ আমি পুটকি দিয়া ভইরা দিমু!” রেগেমেগে বললো রিক্সাওয়ালা। তার প্যাডেল মারার গতি এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। গতি জড়তার কারণে রিক্সাটা ঢিমেতালে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিরক্ত হয়ে রাস্তার ডান দিকে তাকালো ছফা। প্রচুর গাড়ি-বাস-রিক্সা। পুরো শহরের মানুষ যেন রাস্তায় নেমে পড়েছে। পহেলা বৈশাখ মানেই ঘর থেকে বের হওয়া-তারপর রমনা-শাহবাগসহ শহরের কিছু জায়গায় সারাদিন টো টো করে বাড়ি ফেরা। এসব অল্প বয়সী ছেলেছোকরাদেরকে মানায়, বুড়ো খোকাখুকিরাও যোগ দেয়, কিন্তু ছফার কাছে এখন এটা একেবারেই হাস্যকর লাগে।
মুচকি হেসে সিগারেটে জোরে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো সে। রোদের উত্তাপ বেড়ে গেছে, টের পেলো শরীর ঘামতে শুরু করেছে। সূর্যের আলো থেকে চোখ বাঁচাতে এক হাত কপালে ঠেকিয়ে যে-ই না ডান দিকে তাকালো অমনি কিছু একটা ধরা পড়লো তার চোখে।
তার রিক্সার পাশেই একটি প্রাইভেট কার, গাড়ির কাঁচ স্বচ্ছ বলে স্পষ্ট দেখতে পেলো পেছনের সিটে বসে থাকা একমাত্র যাত্রিকে।
আজকের দিনের অনেক মহিলা-তরুণীর মতোই লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, খোঁপায় বেলিফুলের মালা, কপালে লাল টিপ, গলায় একটি মাটির তৈরি হার-পহেলা বৈশাখের সাজে। তবে চোখে সানগ্লাস আছে।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না ছফা। একটু ঝুঁকে তাকালো। সে। তার রিক্সা আর প্রাইভেটকারটি এখন পাশাপাশি আছে। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়ে গেছে বলে থেমে আছে সব যানবাহন।
একমাত্র যাত্রি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ছফাকে লক্ষ্যই করেনি।
মুশকান জুবেরি! তার মতোই ফিরে যাচ্ছে রমনা থেকে?
ছফা টের পেলো তার সমস্ত রোমকূপ দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু সে কিছু করার আগেই গাড়িটা আস্তে করে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। এদিকে ছফার রিক্সাওয়ালা পারিবারিক ঝগড়া-ফ্যাসাদ নিয়ে উত্তেজিত, গালাগালি করে যাচ্ছে মোবাইলফোনে, গতি বাড়ানোর দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। ছফা তার পিঠে চাপড় মেরে তাড়া দিলো। একবার মনে হলো রিক্সা থেকে নেমে দৌড় দেবে কিনা, কিন্তু গাড়িটা ততোক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে।
যেনো মরিচীৎকার মতো ছিলো পুরো দৃশ্যটি-ধরা দিয়েই উধাও!
রিক্সাওয়ালাকে আবারো তাড়া দিলে আরেকটু জোরে প্যাডেল মারলো কিন্তু হতাশ হয়ে ছফা দেখতে পেলো, তার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে গাড়িটা।
আক্ষেপে চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেলো তার। গাড়িটা ধরতে পারেনি বলে নয়, বরং একটি মূল্যবান জিনিস খেয়াল করেনি!
.
অধ্যায় ২
টাইটা আলগা করে নিলো আশেক মাহমুদ, ড্রাইভারকে বললো গাড়ির এসিটা বাড়িয়ে দিতে।
“জি, স্যার,” তার আদেশ পালন করার আগেই বললো ড্রাইভার।
আজকাল তার প্রায় সব আদেশ-নির্দেশের বেলায়ই এই আনুগত্যপূর্ণ ‘জি স্যার’ বলা হয়। এখন যে সিস্টেমের অংশ, সেখানে স্যার-ম্যাডাম মাননীয় বলাটা অলঙ্ঘনীয় আচার। মুচকি হাসলো আশেক মাহমুদ। এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে।
ক্ষমতা!
এ কয় বছরে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা একজন মানুষ হিসেবে সে বুঝে গেছে, এটার উত্তাপ কতোটা তীব্র হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিব সে। চাইলে যেকোনো মন্ত্রী-এমপিকেও মৃদু বকাঝকা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে। এই তো, আজ বিকেলেই, অফিস থেকে বের হবার ঘণ্টাখানেক আগে বিরাট বড় এক শিল্পপতিকে যা-তা ভাষায় ভর্ৎসনা করেছে। জঘন্য একটা আব্দার করেছিলো লোকটি। তার আদরের ভাগ্নে কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করার পর হাতেনাতে রক্তাক্ত বটিসহ গ্রেফতার হয়েছে। এখন চিফ মেট্রোপলিটন কোর্টকে একটু বলে দিলেই ভাগ্নেটা জামিন পেয়ে যাবে-কষ্ট করে আর জেল খাটতে হবে না। বিচার বিচারের মতো চলুক, সেটা পরে ‘দেখা’ যাবে।
আশেক মাহমুদ যে নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা, তা নয়। কোনো তদবিরে যে সাড়া দেয় না সেটাও বলার উপায় নেই। এই কয় বছরে কেবল ঢাকাতেই কিনেছে তিনটি ফ্ল্যাট, কানাডাতেও আছে একটি। ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স হিসেব করলে এক-দেড়শো কোটি টাকার কম হবে না। এসবই হয়েছে দেশের ধনিকশ্রেণির কাছ থেকে পাওয়া ‘উপহার’-এর বদান্যতায়। সে এমন একটি পদে আছে, যেখানে কিছু চাইতে হয় না, চাওয়ার আগেই প্রাপ্তি এসে বসে থাকে তার কোলে। কিন্তু হত্যা-ধর্ষণের মতো ঘটনা থেকে লাভবান হবার কোনো ইচ্ছে তার নেই। কী দরকার, মোটা অঙ্কের ট্রানজাকশানের বিনিময়ে এসব কাজ করে বিবেকের দংশন ডেকে আনা! তার মধ্যে এখনও এসব ব্যাপার-স্যাপার রয়ে গেছে। অতো নীচে নামা সম্ভব হয়নি।
অভাবি একটা মেয়ে, যার তিনকূলে কেউ নেই, পেটের দায়ে শহরে এসে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতো, তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে আর সেটা করেছে বড়লোকের বখে যাওয়া এক কুলাঙ্গার। সেই কুলাঙ্গারের মামা যতো বড় টাকার কুমিরই হোক না কেন, তার আব্দারে সাড়া দেবে না।