ভালো থাকবেন।
বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো ছফার ঠোঁটে।
.
অধ্যায় ২৫
স্কুল দেবার পর দুপুরের আগে কখনও নিজের ঘরে ফিরে এসেছেন কিনা স্মরণ করতে পারলেন না মাস্টার রমাকান্তকামার। এমনকি ছুটির দিনেও তিনি বিকেল পর্যন্ত স্কুল আর লাইব্রেরিতে গিয়ে কাজ করেন। কিন্তু আজকে যে এর ব্যতিক্রম করলেন সেটার কারণ যুক্তিবুদ্ধি নয়-তার স্বজ্ঞা!
নুরে ছফার কিছু কথা, কিছু আচরণ তাকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে : রবীন্দ্রনাথের নামে লাইব্রেরি দেবার জন্যে হলেও মহিলার উচিত ছিলো আপনাকে ধন্যবাদ জানানো-এরকম কথা কেন বললো ঐ ডিবি অফিসার? সে কি কোনোভাবে টের পেয়ে গেছে, রাশেদের স্ত্রী, ঐ মহিলা তার সাথে যোগাযোগ করেছিলো? সেজন্যে তার সন্দেহ, মহিলা আবারো যোগাযোগ করে থাকবে হয়তো?
অসম্ভব!
এ কথা সে কিভাবে জানতে পারবে? সবটাই কি তাহলে অহেতুক ভয়?
ডিবি অফিসার তার কাছে তার ফোন নাম্বারটা চেয়েছিলো-আপনার নিজের কোনো ফোন নেই? তিনি সচেতনভাবে সত্যি-মিথ্যে কিছুই বলেননি, এড়িয়ে গেছেন।
নুরে ছফা স্কুল থেকে চলে যাবার পরই রমাকান্তকামার এই দোলাচলে দুলেছেন। তার অন্তরাত্মা বলছিলো, ঐ চিরকুটটা রেখে দিয়ে মোটেও ভালো কাজ করেননি। যদিও এতোদিনে ওটার কথা প্রায় ভুলেই গেছিলেন।
অনেকক্ষণ স্কুলের অফিসে বসে থাকার পর হুট করেই উঠে পড়েন তিনি। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিলো, ছফা নামের ঐ ডিবি অফিসারের ভাবসাব মোটেও ভালো নয়। এক ধরণের আশঙ্কা করতে থাকেন তিনি, সেটা যে কী, নিজেও জানেন না। জরুরী একটা দরকারে বাসায় যাচ্ছেন বলে সোজা চলে আসেন নিজের বাড়িতে।
এখন ঘরে ঢুকতে গিয়েই মাস্টার দেখতে পাচ্ছেন তার ঘরের তালাটা খোলা! দরজার সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, এরপর আস্তে করে ঘরে ঢুকে চারপাশটা দেখে নিলেন। কেমনজানি একটা অনুভূতি হলো তার। টের পেলেন, প্রচ্ছন্ন একটি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে তার পরিচ্ছন্ন ছোট্ট ঘরটাতে। তিনি যথেষ্ট সাফ-সুতরো থাকেন। তার ঘরে আর যাই হোক, বাজে গন্ধ ভেসে বেড়ানোর কথা নয়-গাঁজার গন্ধ তো দূরের কথা!
দেখে মনে হচ্ছে, ঘরের সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তারপরও পকেট থেকে চাবি বের করে ড্রয়ারটা খুলতে গিয়ে দেখলেন, সেটাও খোলা আছে-ঠিক দরজার তালাটার মতোই!
ড্রয়ারটা খুলে দেখলেন এবার। যে আশঙ্কা করেছিলেন সেটাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে : জরুরী অনেক চিঠিপত্রের সাথে তার মোবাইলফোনটা নেই! তারচেয়েও বড় কথা, ঐ চিরকুটটাও হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
মাস্টারের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। আইনের লোক হয়ে বেআইনীভাবে আরেকজন মানুষের ঘরে চোর পাঠিয়ে তার কাগজপত্র হাতিয়ে নেবার জন্য মনে মনে ভীষণ রুষ্ট হলেন। তিনি নিশ্চিত, ঐ নুরে ছফা লোকটি সম্ভবত আতর আলীকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছে। এক সময় ঐ লোকের পেশা তো চুরিই ছিলো। যেকোনো সময় পুরনো পেশায় ফিরে যাওয়াটা তার জন্য এমন আর কী।
রমাকান্তকামার চুপচাপ নিজের বিছানায় বসে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। গভীর করে নিশ্বাস নিলেন। তিনি যে বুদ্ধের মতো অক্ৰোধি সেটা দাবি করেন না, তবে সজ্ঞানে সব সময়ই চেষ্টা করেন রেগে না যেতে। কিন্তু এ মুহূর্তে ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে, তিল তিল করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার পর উটকো এক লোক এসে সব কিছু তছনছ করে দেবার পায়তারা শুরু করে দিয়েছে।
এই নুরে ছফা লোকটা কি সুন্দরপুরে পা রাখার পর জমিদার বাড়িটা পুড়ে খাক হয়ে যায়নি?
নিজের প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে মাস্টার রমাকান্তকামার বেশ রক্ষণশীল হয়ে উঠেছেন, ঠিক যেভাবে কোনো মা তার সন্তানের অমঙ্গল চিন্তা করে রক্ষণশীল হয়ে ওঠে, আগলে রাখার চেষ্টা করে। কততক্ষণ বিছানায় মূর্তির মতো বসেছিলেন তিনি জানেন না। কিছু একটা শব্দ পেয়ে সম্বিত ফিরে পেলেন।
কেউ তার বাড়ির আঙিনায় পা রেখেছে।
জন্ম থেকে আজ অবধি, আশি বছর ধরে এ বাড়িতে বাস করছেন, বাড়িটা তার দেহেরই অংশ হয়ে গেছে। এখানকার সব কিছু যেনো তার সঙ্গে কথা বলে। কেউ তার বাড়ির চৌহদ্দিতে পা রাখলে তিনি টের পেয়ে যান-যেনো কেউ তার শরীর স্পর্শ করছে।
রমাকান্তকামার আস্তে করে উঠে আলনার পেছনে গিয়ে কাপড়চোপড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকলেন, কিছুক্ষণ পরই দেখতে পেলেন, দরজা ঠেলে সতর্ক পদক্ষেপে ঘরে ঢুকলো এক কিশোর। ছেলেটাকে চিনতে কোনো সমস্যাই হলো না তার। সুন্দরপুরের সবাই তাকে চেনে, তার নাম জানে। খারাপ সঙ্গ আর মাতৃপিতৃহীন এই ছেলেটি অকালেই নষ্ট হয়ে গেছে।
আড়াল থেকে তিনি দেখলেন, বল্টু তার সব কাগজপত্রের সাথে মোবাইলফোনটাও ড্রয়ারে রেখে সেটা চাবি দিয়ে বন্ধ করে বের হয়ে গেলো। তারপরই শুনতে পেলেন, বাইরে থেকে দরজার তালা লাগাচ্ছে। সে।
“তালা মারার দরকার নেই…আমি ঘরে আছি!” আড়াল থেকে বের হয়ে রমাকান্তকামার বেশ শান্তকণ্ঠে বললেন।
এরপর শুধু দৌড়ে চলে যাবার শব্দটাই শুনতে পেলেন তিনি।
প্রচণ্ড রাগ হলো তার। বিছানায় বসে কয়েক বার গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নিলেন। পাজামার পকেট থেকে চশমার কেসিংটা বের করে সেটার ভেতর থেকে একটা সিম বের করে আনলেন এবার। ড্রয়ার থেকে ফোনটা বের করে তাতে সিমটা ভরলেন। কিছুক্ষণ পর একটা নাম্বারে ডায়াল করলেন মাস্টার।