ছফা পা বাড়ালো সেদিকে। চত্বরটা ঘুরে দেখলো সে। সীমানা প্রাচীরটা আরো উঁচু করা হয়েছে, তার উপরে লাগানো হয়েছে তিন ফুটের মতো উঁচু লোহার নেট। সীমানা প্রাচীরের যেদিক দিয়ে ছফা এখানে অনুপ্রবেশ করেছিলো একরাতে, সেদিকে দিকে তাকালো। গাছটা এখনও অক্ষত আছে, তবে সেটার গোঁড়ার দিক থেকে কোমর সমান উচ্চতায় সাদা রঙ করা।
মাঝখানে যে ফোয়ারাটা এখন নেই সেটা ঢোকার সময়ই দেখেছিলো। এখন দেখতে পেলো, মেইন গেটের পাশে আগের দারোয়ানের যে ঝুপড়ি ঘরটা ছিলো সেটাও নেই। পুরো জায়গাটা যথেষ্ট পরিস্কার।
জমিদার বাড়ির দোতলা স্থাপনাটির জায়গায় এখন নতুন একটি একতলা ভবন গড়ে উঠেছে। টিনের চালার এই ভবনটি স্কুলের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেই ভবনের অনেকগুলো দরজা-জানালা। সম্ভবত শিক্ষকেরাও এখানেই বসে।
ছফা এবার ভবনের পাশ দিয়ে ইট বিছানো রাস্তা ধরে পেছনের দিকে চলে গেলো। আগের রাস্তাটা আরো চওড়া করা হয়েছে। পুরনো ইটগুলোর বদলে বসানো হয়েছে নতুন ইট। ভবনের পেছনে যে বাগানটা ছিলো, যেখানে লুকিয়ে থাকার সময় ছ্যাঙ্গার কবলে পড়েছিলো ছফা সে-জায়গাটা আর নেই। ওখানে তিনদিক ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছে তিন তিনটি ভবন। কেবল উত্তর দিকটা খোলা আছে। সেদিক দিয়ে সীমানা প্রাচীর ঘেষে চলে গেছে নতুন রাস্তাটি।
নবনির্মিত ভবনগুলোর দেয়াল ইটের তৈরি, ছাদগুলো টিনের। সারি সারি দরজা জানালা বলে দিচ্ছে এগুলোই স্কুলের ক্লাসরুম। দরজা বন্ধ থাকলেও কিছু খোলা জানালা দিয়ে সে দেখতে পেলো বেঞ্চগুলো।
রাস্তাটা ধরে পুকুর পাড়ের দিকে এগিয়ে গেলো ছফা। ঠিক এভাবেই রাতের অন্ধকারে সে এগিয়ে গেছিলো রহস্যময়ী মুশকান জুবেরিকে অনুসরণ করে, তারপর কয়েক মুহূর্তের জন্য ধোঁকা খেয়েছিলো দুটো দেয়ালের কারণে।
আশ্চর্য হয়ে ছফা দেখতে পেলো, দেয়াল দুটো এখনও আছে। এতে কিছুর পরিবর্তনের মধ্যে এরকম একটি দেয়াল কেন টিকিয়ে রাখা হলো সেটা বুঝতে পারলো না।
ঠিক তখনই শুনতে পেলো, দূর থেকে ভেসে আসছে একদল ছেলেমেয়ের সমবেত কণ্ঠের গান :
…আজ আমাদের ছুটি ও ভাই
আজ আমাদের ছুটি…
আহা হাহা হা
আরেকটু এগিয়ে গেলো সে। গানের আওয়াজ বেড়ে গেলো এবার।
কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি
আহ হাহা হা…
দেয়ালের প্রবেশ মুখ দিয়ে ঢুকে ছফা এবার ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ঠিক এ জায়গাতেই, একটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে সে দেখেছিলো মুশকান জুবেরিকে কিছু একটা মাটি চাপা দিতে। মহিলার সঙ্গে ছিলো গোরখোদক ফালু। তবে এখন আর কোনো ঝোঁপ নেই। জায়গাটা বেশ পরিস্কার। পুকুর পাড়ের চারপাশ ঘিরেই সবুজ ঘাসের চত্বর।
মুশকান জুবেরি যেখানে বস্তাবন্দী করে রেডওয়াইন মাটির নিচে পুঁতে ফেলছিলো, ঠিক সেখানেই একদল ছেলেমেয়ে বসে আছে শতরঞ্জির উপরে। তাদের সামনে বেতের মোড়াতে বসে আছে ঐ তরুণী-মাস্টারের
অফিস রুমে একটু আগে যাকে দেখেছিলো।
কেয়া পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে
তালদীঘিতে ভাসিয়ে দেব চলবে দুলে দুলে।
রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে…
ছেলেমেয়েরা সমবেত কণ্ঠে গান গেয়ে যাচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে কথা আর সুর ঠিক আছে কিনা লক্ষ্য রাখছে সেই তরুণী, কিন্তু মেয়েটা চকিতে ছফাকেও দেখে নিলো। তার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। একজন আগন্তুক যে দূর থেকে তাদেরকে দেখছে সেটা গান গাইতে থাকা বাচ্চাগুলো অবশ্য এখনও টের পায়নি।
“আমাদের গানের মাস্টার।”
ছফা চমকে তাকালো পেছনে, দেখতে পেলো বাদামি রঙের কুতা আর পায়জামা পরা মাঝবয়সী এক লোক নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
“খুবই ভালো গান করে…শান্তিনিকেতন থেকে এসেছে।”
ভুরু কপালে তুললো ছফা। “তাই নাকি।”
“জি।”
“আপনি…?”
“আমি এখানকার কেয়ারটেকার। আপনি কে? কোত্থেকে এসেছেন?”
“ঢাকা থেকে এসেছি,” আর কিছু বললো না ছফা। পুকুর পাড়ের ওপাশে, যেখানকার ডোবায় মুশকান জুবেরি কুমির চাষ করতো, সে জায়গাটার দিকে চোখ গেলো তার। একদমই বদলে গেছে। মাটি ফেলে জায়গাটা উঁচু করা হয়েছে এখন, সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে দুটো ভবন-মূল স্কুল ভবনের আদলেই তৈরি করা হয়েছে ওগুলোইটের দেয়াল আর টিনের ছাদ।
তবে দুটো ভবনের মাঝখানে প্রাচীর দিয়ে পৃথক করা।
“ওগুলো ডরমিটরি,” ছফার চোখ অনুসরণ করে কেয়ারটেকার বললো। “ছেলে আর মেয়েদের আলাদা আলাদা দুটো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা, দেখতে পেলো ডরমিটরিতে ঢুকতে দুটো আলাদা মেইন গেট আছে, আর পুরো জায়গাটা উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা।
প্রশংসার অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো তার চোখেমুখে। “মাস্টারসাহেব দেখি ছোটোখাটো শান্তিনিকেতন বানিয়ে ফেলেছেন!”
হেসে ফেললো কেয়ারটেকার। “এটা উনার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিলো।”
“বিশাল কাজ করেছেন,” সত্যি সত্যিই বললো ছফা, কথাটার মধ্যে টিটকারির লেশমাত্রও নেই।
মাথা নেড়ে সায় দিলো মাঝবয়সী কেয়ারটেকার। মুখে এখনও হাসি ধরে রেখেছে।
“কিন্তু এতো কিছু কিভাবে করলেন?”
লোকটার হাসি মিইয়ে গেলো। ছফার এ প্রশ্নের মধ্যে কেমনজানি একটা ইঙ্গিত আছে। “কিভাবে মানে?”
“এই যে, বিরাট একটি আবাসিক স্কুল, এতো বড় আয়োজন, এসব করতে তো অনেক টাকা লাগার কথা।”
আবারো হাসি ফিরে এলো কেয়ারটেকারের মুখে। “ট্রাস্টের জমিজমার পরিমাণ তো অনেক। তাছাড়া স্থানীয় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ভোনেশন দিয়েছে। আমাদের নতুন এমপি আবার মাস্টারসাহেবের ছাত্র ছিলেন,