“শুনুন ছফাসাহেব,” বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন মাস্টার। “রবীন্দ্রনাথ শুধু একজনের পছন্দের মানুষ নন। তাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে, অনুসরণ করে এরকম মানুষ এই ভূ-ভারতে অনেক আছে। আমিও তাদের একজন। তাই বলে ভাববেন না, আমার ইচ্ছেয় নামটা দিয়েছি। সত্যিটা হলো, অলোকনাথ বসুর পিতা যে লাইব্রেরিটি দিয়েছিলেন, স্বয়ং কবিগুরুর যেটা উদ্বোধন করার কথা ছিলো, সেটার নাম ছিলো ‘শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গণগ্রন্থাগার।’ এটা সুন্দরপুরের খুব কম মানুষই এখন জানে। বিস্মৃত ইতিহাস বলতে পারেন। আমি শুধু নতুন করে ওটা আবার দিয়েছি।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। “আপনি এবার আসতে পারেন।”
ছফা কিছু বলতে যাবে অমনি ঘরটা ভরে উঠলো মাদকতাপূর্ণ একটি গন্ধে।
“রমাকান্ত মশাই…” সুললিত একটি কণ্ঠ বলে উঠতেই মাঝপথে থেমে গেলো।
পেছন ফিরে ছফা দেখতে পেলো এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। তাতের শাড়ি পরা মেয়েটিকে দেখেই মনে হলো পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে জড়ো হওয়া হাজারো তরুণীদের একজন।
মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হলো ছফার। মাস্টারের ঘরে অপরিচিত কাউকে দেখতে পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সে।
“আপনি মনে হচ্ছে ব্যস্ত, আমি তাহলে পরে আসি?”
“কোনো সমস্যা নেই, বলুন, কী বলতে এসেছিলেন,” বললেন রমাকান্তকামার।
ছফার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাস্টারের দিকে ফিরলো তরুণী। “বোশেখের অনুষ্ঠানে তানপুরাটার তার ছিঁড়ে গিয়েছিলো, ওটার তার কেনা লাগবে।”
“শ্যামলকে বলে দিচ্ছি, ও কিনে নিয়ে আসবে।”
“ঠিকাছে।” বলেই ছফার দিকে আবার আড়চোখে তাকিয়ে ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে গেলো মেয়েটি।
আশ্চর্য হলেও সত্যি, মেয়েটাকে দেখে নুরে ছফার কেন জানি মুশকান জুবেরির কথাই মনে পড়ে গেলো! এটার কারণও সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারলো সে-তাদের দুজনের বাচনভঙ্গি আর সাজপোশাকের বেশ মিল আছে। মেয়েটা প্রমিত বাংলায় কথা বলে, মুশকান জুবেরিও এভাবে কথা বলতো। বলে। শুধরে দিলো নিজেকে। ঐ মহিলা তো আর লোকান্তরিত হয়ে যায়নি। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথাও, আর শিকার করে যাচ্ছে।
“আমাদের গানের শিক্ষিকা।”
“ও,” আস্তে করে বললো ছফা। “আপনার ফোন নাম্বারটা একটু দেয়া যাবে?”
রমাকান্তকামার কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন ছফার দিকে, তারপর আস্তে করে ড্রয়ার থেকে একটা কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিলেন।
কার্ডটা হাতে নিয়ে হতাশ হলো সে-ল্যান্ডফোনের নাম্বার। “এটা তো এখানকার অফিসের নাম্বার?”
“হুম।”
“আপনার নিজের কোনো ফোন নেই?”
“আপনি এই নাম্বারেই আমাকে পাবেন।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ছফা। “ঠিক আছে, আমি তাহলে আসি।” দরজার দিকে যেতেই আবার ঘুরে দাঁড়ালো। “আপনার স্কুলটা কি ঘুরে দেখতে পারি? অনেক পুরনো স্মৃতি আছে এখানে, বুঝতেই পারছেন। তাছাড়া, স্কুলটার অনেক প্রশংসা শুনে ফেলেছি, তাই একটু ঘুরে দেখার লোভটা সামলাতে পারছি না।”
স্থিরচোখে তাকিয়ে বললেন মাস্টার, “ঘুরে দেখতে পারেন, সমস্যা নেই।”
“ধন্যবাদ, আপনাকে।” কথাটা বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো ছফা।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। ডেস্কের বেলটা বাজাতেই কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকলো মাঝবয়সী এক লোক।
“স্যার?”
“আলী, একটু আগে আমার ঘর থেকে যে লোকটা বের হয়ে গেলো তাকে একটু চোখে চোখে রেখো। সে কী করে না করে লক্ষ্য রাখতে হবে।”
“ঠিক আছে, স্যার।”
আলী নামের লোকটা ঘর থেকে চলে গেলে আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রমাকান্তকামার। এরকম কাজ করার কোনো ইচ্ছে কিংবা রুচি নেই তার, কিন্তু এখন না করেও পারলেন না। নুরে ছফা নামের লোকটাকে তার সুবিধার বলে মনে হয়নি কখনও। তার চাইতেও বড় কথা, এর মতিগতি বুঝতে পারছেন না।
.
অধ্যায় ২৩
মাস্টার রমাকান্তকামারের অফিস থেকে বের হয়ে চারপাশে তাকালো নুরে ছফা। জমিদার বাড়িটা বেশ বদলে গেছে। এক সময় জমকালো পুরনো ভবনটি আর নেই। ওটা যে তিন বছর আগে আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে সে-কথা তার চেয়ে ভালো কে জানে!
তবে বাড়িটার চৌহদ্দি আগের মতোই আছে, ভেতরে কিছু নতুন স্থাপনা তৈরি হওয়াতে প্রথম দেখায় মনে হয় অন্য কোনো জায়গা বুঝি। সামনের প্রাঙ্গনটা একেবারে পাল্টে ফেলা হয়েছে। ওটা এখন ইট বিছানো একটি চত্বর। চত্বরটাতে সাদা রঙ দিয়ে দাগ টানা। ছাত্রছাত্রিরা এখানে জড়ো হয় ক্লাস শুরুর আগে। তারপর হালকা ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করে-ছফারা যেটাকে বলতো পিটি ক্লাস।
আরামে দাঁড়াও…সোজা হও।
স্কুলের পিটি স্যারের পুরু গোঁফের মুখটার ছবি ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়। সাদা গেঞ্জি আর সাদা প্যান্ট পরা থাকতো, মাথায় থাকতো সানক্যাপ। একটা হুইসেল বাজিয়ে তাদেরকে অর্ডার দিতেন। খুবই জাঁদরেল ছিলেন, নানান ধরণের খেলাধূলায় উৎসাহ দিতেন। লোকটার ভুড়ি ছিলো বলে আড়ালে আবডালে তাকে তারা পেটালি’ বলেও ডাকতো।
প্রাঙ্গনের মাঝখানে ফ্ল্যাগপোলটা চোখে পড়লো এবার। সবই আছে, পতাকাটা নেই। ক্লাস শুরুর আগে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় ওটাতে ফ্ল্যাগ লাগানো হয় নিশ্চয়। এখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রিরা গেয়ে ওঠে : আমার সোনার বাংলা…আমি তোমায় ভালোবাসি।