একদিন পোস্ট অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, ঢাকা থেকে জরুরী একটা চিঠি এসেছিলো তার। ডাক হরকরা সুবিদ মিয়া তাকে দেখে পোস্ট অফিসে নিয়ে গিয়ে এক কাপ চা খাইয়ে চিঠিটা দিয়ে দেয়। সেই চিঠি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বিশাল বড় এক বটবৃক্ষের নিচে একটু জিরিয়ে নেন তিনি। বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে চিঠিটা পড়তে গিয়ে টের পান দূর থেকে আতর আলী উৎসুক চোখে তাকে দেখছে। তিনি চিঠিটা পড়ার পর ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেন পাশে, তারপর উঠে রওনা দেন বাড়ির দিকে। কিছুটা পথ যাবার পর একটা পুরনো শিব মন্দিরের ধ্বংস্তূপের কাছে এসে পেছনে ফিরে দেখেন আতর সেই চিঠির টুকরোগুলো কুড়াতে ব্যস্ত। এই দৃশ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিলো তার ভেতর থেকে।
এখনও সেই একই দীর্ঘশ্বাস আর ভাবনা তাকে পেয়ে বসলো।
“আদাব, মাস্টারসাহেব।”
রমাকান্তকামারের ভাবনায় ছেদ পড়লো, দরজার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন ডিবি অফিসার নুরে ছফা দাঁড়িয়ে আছে।
“আপনি তো দেখি বিশাল কাজ করে ফেলেছেন, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো সে।
চোখেমুখে নির্বিকার ভঙ্গি মাস্টারের। “বসুন,” তার ডেস্কের সামনের চেয়ারগুলোর একটা দেখিয়ে বললেন।
মাস্টারের এই অফিস ঘরটি এককালে জমিদার বাড়ির মূল ভবনের পাশে যে লাগোয়া দোতলাটি ছিলো সেটার নিচতলায় অবস্থিত। ভেতরে এবং বাইরে, পুরোপুরি নতুন করে সাজানো হলেও মূল স্থাপনাটি একই আছে।
একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো ছফা। “কেমন আছেন?”
“ভালো,” ছোট্ট করে জবাব দিলেন রমাকান্তকামার।
“স্কুলটার খুব নামডাক হয়ে গেছে। এতো অল্প সময়ে দারুণ কাজ করেছেন মনে হচ্ছে।”
স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন মাস্টার। এসব আলগা কথাবার্তায় তার কোনো আগ্রহ নেই। আসল কথার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।
“এখানকার নিরাপত্তা দেখি সেই রকম!” কথাটা প্রশংসার মতো শোনালো না অবশ্য। “আমি তো খুবই অবাক হয়েছি। ঢাকার স্কুলেও এরকম নিরাপত্তা দেখিনি। ভালো, খুব ভালো।”
“এটা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল,” আস্তে করে বললেন মাস্টার। এখানে। ছাত্র-ছাত্রিদের দুটো ডরমিটরি আছে। এর সাথে অন্য স্কুলের তুলনা করলে ভুল করবেন।”
ভুরু কপালে তুলে বললো ছফা, “তা অবশ্য ঠিক।”
“এখন বলুন, আমার কাছে আবার কীজন্যে এসেছেন।”
মাস্টারের কণ্ঠস্বরে আন্তরিকতাবিবর্জিত সুরটা ধরতে বেগ পেলো না। “আপনার কি তাড়া আছে?”
“হুম। যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।”
“আচ্ছা, মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো ছফা। “ঐ মহিলা…মুশকান জুবেরি কি আপনার সাথে যোগাযোগ করেছিলো এরপর?”
আস্তে করে গভীরভাবে দম নিয়ে নিলেন রমাকান্তকামার। “না।”
“এ কয় বছরে একবারও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি?”
এবার শুধু মাথা দুলিয়ে জবাব দিলেন মাস্টার।
“অন্য কারোর মাধ্যমেও না?” রমাকান্তকামারের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আবার বললো, “এতো কিছু করলেন আর মহিলা একটা ধন্যবাদও দিলো না আপনাকে? অন্তত কাউকে দিয়ে তো এটুকু বলতেই পারতো, ‘মাস্টারসাহেব, আপনি দারুণ কাজ করেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ’?”
মাস্টার কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে একটু চমকে গেলেন কথাটা শুনে।
“রবীন্দ্রনাথের নামে লাইব্রেরি দেবার জন্যে হলেও মহিলার উচিত ছিলো আপনাকে ধন্যবাদ জানানো,” আফসোসের সুরে বললো নুরে ছফা। “তার সাধের রেস্টুরেন্টটা না থাকলেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ঠিকই টিকে আছে। লোকে আগেও বলতো রবীন্দ্রনাথে যাই, এখনও সেটাই বলে।”
“আপনি ধরেই নিয়েছেন এমন নামকরণের সাথে ঐ ভদ্রমহিলার সম্পর্ক আছে,” একটু রুষ্ট হয়ে বললেন রমাকান্তকামার।
মুচকি হাসলো ছফা। “ধরে নেবার কিছু নেই, যুক্তিবুদ্ধি সেটাই বলে।”
“আপনি সম্ভবত জানেন না, রবীন্দ্রনাথের ‘ন্দরপুরে আসার উপলক্ষ্যে এখানে একটি লাইব্রেরি উদ্বোধন করার কথা ছিলো। সেজন্যে অলোকনাথ বসুর পিতা ত্রিলোকনাথ চমৎকার একটি লাইব্রেরি করেছিলেন।”
নুরে ছফা ভুরু কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মাস্টারের দিকে।
“বটগাছের কাছে, এখন যেখানে পেট্রলপাম্পটা আছে…ওখানেই ছিলো পয়ষট্টি সাল পর্যন্ত। এর পর রায়টের সময় ওটা পুড়িয়ে দেয় দাঙ্গাবাজেরা।”
ছফাও জানে, সব যুগেই দাঙ্গাবাজ আর ধর্মান্ধদের আক্রমণের শিকার হয়েছে গ্রন্থাগার। পশ্চাদপদ চিন্তাভাবনার সাথে গ্রন্থাগারের বিরোধ সুপ্রাচীন।
“পরে আর ওটা মেরামত করার চেষ্টা করেনি জমিদার বাড়ির কেউই। অলোকনাথ বসু অবশ্য আমাকে বলেছিলেন লাইব্রেরিটা আবার নতুন করে করার কথা ভাবছেন তিনি। এরপর একাত্তর চলে এলো, জমিদারের বংশ শেষ!” দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললেন তিনি। “স্বাধীনের পর সরকার মহাসড়ক বানানোর জন্য জমিদারদের সম্পত্তির বেশ কিছু অংশ অধিগ্রহণ করে…লাইব্রেরিটা যেখানে ছিলো, ওটার উপর দিয়েই চলে যায় নতুন সড়কটি।”
“তাই আপনি ঠিক করলেন আবার একটা লাইব্রেরি করা দরকার ওখানে?”
মাস্টার কিছুই বললেন না।
“বুঝলাম। কিন্তু এটা বুঝলাম না, মহিলার রেস্টুরেন্টের সাইনটা রেখে দিলেন কেন?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রমাকান্তকামার। রেস্টুরেন্টটার সাইন যখন সরানো হচ্ছিলো তখন তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সেটা। ডান দিক থেকে সাইনটার একেকটি শব্দ খুলে ফেলা হচ্ছিলো। শেষে যখন ‘রবীন্দ্রনাথটা খুলতে যাবে তখন মাস্টারের মন সায় দিলো না। এ নামেই তো লাইব্রেরিটা হবে, তাহলে নামটা থেকে গেলে কী আর সমস্যা! লাইব্রেরি যদি আলোর আধার হয়ে থাকে, তাহলে আলোকিত রবীন্দ্রনাথ থাকতেই পারে! সত্যি বলতে, রবীন্দ্রনাথ নামটা অপসারণ করতে তার মন সায় দিচ্ছিলো না।