মানুষের বোকামির কথা ভেবে হাসি পায় বল্টুর। তালা কেনার সময়ই তারা সবচেয়ে বেশি কিপ্টেমি করে। লাখ টাকার জিনিস পাহারা দিতে কিনা পঞ্চাশ টাকা দামের তালা কেনে!
পকেট থেকে মাস্টার কি-টা বের করে তালাটা খুলে ফেললো সে। ঘরটাতে বেশি কিছু নেই। তবে মানুষ কোথায় কী রাখতে পারে সেই ট্রেনিংও দিয়েছে তার ওস্তাদ।
ঘরে কাপড়-চোপড় রাখার একটা আলনা, পুরনো দিনের নক্সাওয়ালা পালং, বই, নানান রকম ফাইলভর্তি একটি আলমিরা আর পড়ার টেবিল চেয়ার। বল্টু প্রথমে টেবিলের ছোট্ট ড্রয়ারটার দিকেই হাত বাড়ালো। এটারও লক রয়েছে, সেই লক খুলতেও বেগ পেতে হলো না।
ড্রয়ারের ভেতরে কিছু চিঠিপত্র আর একটা মোবাইলফোন আছে চাজারসহ।
বল্টুর চোখেমুখে হাসি ফুটে উঠলো। চিঠিগুলোসহ ফোনটা নিয়ে নিলো সে। চাজারটা নেবার দরকার না থাকলেও বাকি জিনিসের সাথে ওটা পকেটে ভরে নিলো। সস্তা চায়নিজ ফোনের চার্জার, কিন্তু বিশ টাকা হলেও চোরাই মার্কেটে বিক্রি করা যাবে। তার কাজ শেষে হয়ে গেলেও স্বভাবগত কারণেই ঘরের আশেপাশে নজর বুলালো আরেকবার। মাস্টার এখন বিশাল সম্পত্তি দেখাশোনা করেন, বিরাট বড় একটা স্কুল আর লাইব্রেরি চালান, প্রচুর টাকা খরচ করতে হয় তাকে। নিশ্চয় ঘরে কিছু না কিছু থাকবে।
পরক্ষণেই আতর আলীর সাবধান বাণীটা তার মগজে উচ্চারিত হলো : কোনো কিছু যদি সরাইছোস তো তুই শ্যাষ! এক্কেবারে কব্জি থেইক্যা হাত কাইট্যা ফালামু!
সঙ্গে সঙ্গে চার্জারটা আবার ড্রয়ারে রেখে দিলো বল্টু। আতর আলী তার ওস্তাদ না হতে পারে, কিন্তু এই লোককে জমাখরচ দিয়ে চলতে হয়। থানার সাথে তার সেইরকম খাতির। তাকে বিগড়ানো ঠিক হবে না।
এই প্রথম বল্টু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রায় খালি হাতেই বের হয়ে এলো কোনো বাড়ি থেকে! তবে বের হবার সময় দরজার তালাটা আর লাগালো না। আবারও তাকে আসতে হবে-একটু পরই। কী দরকার লক করে রাখার।
.
অধ্যায় ২২
এটা যে ঘটবে, রমাকান্তকামার জানতেন। গতকাল লোকটাকে দেখার পরই বুঝতে পেরেছিলেন, তার কাছে এসে আবারো সেই একই কথা জানতে চাইবে। তিন বছর আগে যখন অলোকনাথের নাতবৌ জমিদার বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো, তার সপ্তাহখানেক পরই এই লোক দ্বিতীয়বারের মতো সুন্দরপুরে এসেছিলো, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। লোকটার সন্দেহগ্রস্ত মানসিকতা পছন্দ করেন না তিনি। জগতের সবকিছুকে সন্দেহের চোখে দেখাটা এক ধরণের বাতিক। এটাকে তিনি সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে দেয়া অভিশাপ বলেও মনে করেন।
দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার ভেতর থেকে। আবারো সেই একই প্রশ্ন করবে এই লোক-আপনাকে কেন ট্রাস্টি করে দিয়ে গেলো মুশকান জুবেরি? সে এখন কোথায়? তার সাথে আপনার কি যোগাযোগ আছে?
রমাকান্তকামার জানেন, তার দিক থেকে জবাবটা আগের মতোই হবে-এটা আপনি ঐ ভদ্রমহিলাকেই জিজ্ঞেস করলে ভালো হয়। তার খবর আমি রাখি না।
ভদ্রমহিলা?!
ঐদিন ছফা নামের লোকটা যেনো ক্ষেপে গেছিলো কথাটা শুনে। আপনি তাকে ভদ্রমহিলা মনে করেন? বলেছিলো সে, মাথা দোলাতে দোলাতে। তারপর কিছু একটা বলতে গিয়েও বলেনি। শুধু বলেছিলো, তার নাকি কোনো ধারনাই নেই ঐ মহিলা কী করে।
“এসব জেনে আমি কী করবো?” রমাকান্তকামার সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছিলেন। “উনার সাথে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই, কোনো লেনদেন নেই।”
ডিবি অফিসার মুচকি হেসেছিলো কথাটা শুনে। “কিছুই নেই, তারপরও আপনাকেই ট্রাস্টি করে এতো বড় সম্পত্তি দিয়ে গেলো?”
রমাকান্তকামার বিরক্ত হয়েছিলেন কথাটা শুনে। “আমাকে উনি একরত্তি সম্পত্তিও দিয়ে যাননি। আপনি ভুলে গেছেন, উনি একটি ট্রাস্টে দান করে গেছেন সবকিছু।”
“আর সেটার ট্রাস্টি করে গেছেন আপনাকে!”
লোকটার চোখেমুখে সন্দেহ উপচে পড়ছিলো। যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি, তবে সেটা প্রকাশ করেননি, বরং যুক্তি দিয়ে কথা বলেছিলেন। “ঐ ভদ্রমহিলা এটা করতে বাধ্য হয়েছেন।”
কথাটা শুনে ছফার ভুরু কপালে উঠে গেছিলো। “বাধ্য হয়েছেন?!”
“হুম। সম্পত্তিটা যার নামে, সেই রাশেদ জুবেরি এটা চেয়েছিলেন, একটু থেমে আবার বলেছিলেন, “আর মহিলা সেটাই করেছেন।”
“তাহলে এতো দিন পরে কেন? পালিয়ে যাবার ঠিক আগেই?”
“সেটা ঐ মহিলাই ভালো জানেন,” বলেছিলেন রমাকান্তকামার। “ধরে নিলাম উনি আসলেই একজন অপরাধী…তাতে কী? সম্পত্তিটা তো উনার ছিলো না।”
ডিবি অফিসার এ কথার কোনো জবাব দেয়নি।
“উনার অপরাধ প্রমাণিত হয়ে থাকলেও সম্পত্তিগুলো দান করার অধিকার উনি রাখতেন…যদি না আদালত এ ব্যাপারে কোনো বাধা দিতো।”
তার এমন কথায় মুচকি হাসি ফুটে উঠেছিলো লোকটার ঠোঁটে। “আইন-কানুন সম্পর্কে তো দেখি ভালো ধারণাই রাখেন।”
টিটকারিটা গায়ে না মেখে তিনি বলেছিলেন, “তা রাখি না। তবে জগতের সকল আইন-কানুন তৈরি হয়েছে কাণ্ডজ্ঞান থেকে, সেটা নিশ্চয় আমার আছে।”
এ কথা শোনার পর কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে চলে গেছিলো ডিবি অফিসার। সেই যে গেলো আর আসেনি। বিগত তিন বছরে তার টিকিটাও দেখা যায়নি সুন্দরপুরে। তবে লোকটার ছায়া ঠিকই মাস্টারকে অনুসরণ করে গেছে পরবর্তী কয়েকটি মাস।
এই সুন্দরপুরের সবাই তাকে পুলিশের ইনফর্মার হিসেবেই চেনে। চুরি থেকে শুরু করে মাদক বিক্রি, হেন কাজ নেই সে করে না। মাস্টার লক্ষ্য করেছেন, লোকটা কেমন ছায়ার মতো অনুসরণ করতে শুরু করেছিলো। তাকে। তিনি যেখানেই যেতেন, পিছু নিতো আতর।