“তুমি উনারে স্যারের কাছে নিয়া যাও, শ্যামল,” ছেলেটাকে বললো দারোয়ান।
তিন বছর পর নুরে ছফা মেইন গেটটা পেরিয়ে এক সময়কার জমিদার বাড়ির ভেতরে পা রাখলো আবার।
.
অধ্যায় ২১
ছোট্ট এই জীবনে অনেক চুরি করেছে বল্টু। শুরুটা হয়েছিলো মায়ের আঁচলে বেঁধে রাখা টাকা-পয়সা সরানো থেকে। তার মা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতো রান্না করার সময় আঁচল থেকে চুপিসারে টাকা সরাচ্ছে সে। কী নিখুঁতই ছিলো তার হাত! সেই প্রথম থেকেই।
একটু বড় হবার পর বুঝেছিলো, ঘরের টাকা চুরি করার মধ্যে বীরত্ব যেমন নেই, তেমনি লাভজনকও না। অর্থনীতির জটিল সমীকরণে না গিয়েই সে বুঝে গিয়েছিলো, ঘরের বাইরে নজর দিতে হবে। সেই থেকে চুরি করার বিদ্যেটা ভালোমতোই কাজে লাগাতে শুরু করে। কিন্তু মানুষের পকেট কেটে বিখ্যাত হারুকাটা একদিন হাতেনাতে ধরে ফেলে তাকে। পাশে ছাতা রেখে চায়ের দোকানে বসে এক মুরুব্বি চা খাচ্ছিলো, বল্ট সেই ছাতাটা সবার অলক্ষ্যে মেরে দেয়, কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা হারুকাটা পকেটমার তাকে ধরে ফেলে হাতেনাতে।
ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলো সে। ওটাই ছিলো তার প্রথম ‘কট খাওয়া’র কেস। কিন্তু হারু যখন বললো, “গাধার বাচ্চা, বুইড়ার পকেটে কয়েক শ’ ট্যাকা থাকতে বালের এই বিটিশ আমলের ছাত্তিটা মারলি ক্যান?” তখনই সে বুঝে গেছিলো, যোগ্য ওস্তাদের খপ্পরেই পড়েছে।
এরপর থেকে হারু তার ওস্তাদ বনে যায়। কিভাবে পকেট কাটতে হয়, তালা খোলা যায়, কিভাবে বুঝবে কার পকেটে টাকা আছে আর কার পকেটে আছে বিড়ি-গুলের মতো অপ্রয়োজনীয় জিনিস-সবই শিখিয়ে দিয়েছিলো। বিনিময়ে প্রথম দু-বছর তাকে হারুর চ্যালা হয়ে কাজ করতে হয়। ইনকামের প্রায় বেশির ভাগই নিয়ে নিতো হারুকাটা। ততোদিনে তার বাবা আরেক মহিলাকে বিয়ে করে ফেলেছে, আর তাকে ফেলে চলে গেছে জন্মদাত্রি মা। কার সাথে কোথায় যে গেছে সেটা আজো জানতে পারেনি বল্টু। এরপর থেকে তার আশ্রয় জোটে হারুকাটার ঘরে। ভোরে উঠেই তাকে চলে যেতে হতো বাসস্টেশনে, ‘ইনকাম করার পরই কেবল নাস্তা জুটতো কপালে। ওস্তাদ হিসেবে এমনই কঠিন ছিলো হারু।
সারাটা দিন টই টই করে ঘুরে বেড়িয়ে পকেট মারতো, চুরি করতো। তবে আলতু ফালতু জিনিস চুরি করলে হারুকাটার লোহার মতো শক্তহাতের থাপ্পড় জুটতো দুই গালে। সেই থাপ্পড়ের ভয়ে চুরিবিদ্যেটা আরো শাণিত করে নেয় সে। বড় বড় দান মারতে শুরু করে কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হতো না। দিনকে দিন হারু তার শশাষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।
অনেক রাত শুয়ে শুয়ে বল্টু ভেবেছে, হারুর কাছে তার যে ঋণ সেটা শোধ হয়ে গেছে অনেক আগেই-এখন তাকে মুক্তি পেতে হবে। তার ছোট্ট মাথা থেকে অবশ্য কোনো উপায় বের হতো না। এক পর্যায়ে সে ধরেই নিয়েছিলো, হারুকাটার সাথেই কাটিয়ে দিতে হবে বাকি জীবনটা।
সেটা অবশ্য হয়নি। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবেই মুক্তি পেয়ে যায় সে। পাশের এক টাউনে পকেট মারতে গিয়েছিলো তার ওস্তাদ, বড় দান মারতে বেছে নিয়েছিলো বিয়ে বাড়ির মতো একটি অনুষ্ঠান। কপাল খারাপ ছিলো, ধরা পড়ে যায় হাতেনাতে। মারমুখি জনতার গণপিটুনি আর সহ্য করতে পারেনি, ভবের লীলা সাঙ্গ করে হারুকাটা চলে যায় পরপাড়ে।
ওস্তাদের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর একটু মন খারাপ করেছিলো বল্টু। ইশ, ওস্তাদ যদি তার মতো গণপিটুনি খাওয়ার সময় পায়খানা করে দিতো। সেই পায়খানা হাতে নিয়ে লোকজনকে দেখিয়ে বলতো : আর মাইরেন না…দেহেন, হাইগ্যা দিসি!-তাহলে তার মতোই বেঁচে থাকতো এখন। বল্টু এই পদ্ধতি খাঁটিয়ে বেশ কবার বেঁচে গেছে। লোকজন জ্যান্ত মানুষকে মারতে ভয় পায় না, কিন্তু মানুষের গু নিজের হাতে-পায়ে-শরীরে লাগাতে ভয় করে! শেষ অস্ত্র হিসেবে এটা খুবই কার্যকরী। কাঁদো কাঁদো হয়ে মানুষের মায়া-মমতা আদায় করার যে পুরনো টেকনিক তার ওস্তাদ তাকে শিখিয়েছে সেটা এখন আর কাজে লাগে না। মানুষ বড়ই পাষান হয়ে গেছে!
বল্টুর হাতে অনেক সময় আছে। মাস্টার এখন আছেন স্কুলে, তার আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়। সেজন্যে তাড়াহুড়ো করার কোনো মানেই হয় না।
মাস্টারের ভিটের কাছে এসে সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশটা দেখে নিলো আরেক বার। রমাকান্ত মাস্টার থাকেন এমন এক ভিটায়, যার চারপাশে খুব কম বাড়িঘরই আছে। ভিটার চারদিকে ক্ষেতিজমি, সেইসব জমিতে কিছু কামলা আগাছা সাফ করতে ব্যস্ত। মাস্টারের ভিটা থেকেও তাদের অবস্থান বেশ দূরে। তার চেয়েও বড় কথা, সবাই মাথা নিচু করে কাজ করে যাচ্ছে। তারা আজাইরা আর অকর্মা মানুষ নয় যে, আশেপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে। সেদিকে নজর রাখবে।
বল্টু আস্তে করে উঁচু ভিটাতে উঠে গেলো সবার অগোচরে। পুরো বাড়িটা যেনো শশ্মানের মতোই খাঁ-খাঁ করছে। চারদিকে গাছগাছালি থেকে পাখির কিচিরমিচির ডাক ছাড়া আর কিছু নেই। আমগাছের মুকুল থেকে গন্ধ ভেসে আসছে।
মাস্টারের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে আরেকবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো। এরকম সতর্কতা তাকে শিখিয়েছে হারুকাটা ওস্তাদই-ভুলেও ধরে নেয়া যাবে না, আশেপাশে কেউ নেই।
বল্টুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এখন যে কাজটা করতে যাচ্ছে সেটা পানির মতোই সহজ। এখানে ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। একটা মাঝারি আকারের চায়নিজ তালা মারা আছে মাস্টারের ঘরের দরজায়। ওটা খোলার জন্য তেমন কিছুই করতে হবে না। তার কাছে একটা মাস্টার-কি আছে, সেটা দিয়ে সুন্দরপুরের অর্ধেক তালা খোলা যাবে!