নুরে ছফা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে গেলো সেই পথ দিয়ে। পথের দু পাশের বিস্তীর্ণ ফসলিজমি আগের মতোই রয়েছে। মহাসড়ক থেকে সবুজ ফসলি জমির বুক চিড়ে চলে গেছে কালো পিচের রাস্তা। মাথার উপরে দগদগে সূর্য। চোখ ধাঁধানো প্রকৃতি চারপাশে। তার নিজের গ্রামের কথা মনে পড়ে গেলো। প্রতিটি গ্রামই প্রায় একই রকম লাগে তার কাছে।
হাঁটতে হাঁটতে জমিদার বাড়ির কাছে চলে এলে দেখতে পেলো, সদর দরজাটা আর আগের মতো নেই, বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণটিও বেশ বদলে গেছে। দেখেই বোঝা যায়, নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়। এক সময়কার জমিদার বাড়ির মূল ফটকটি এখন শক্ত মজবুত লোহার গ্রিলের বিশাল দরজায় বদলে গেছে। সেই দরজার উপরে অর্ধ-বৃত্তাকারের খিলান সদৃশ একটি সাইনবোর্ড : সুন্দরপুর শান্তিনিকেতন উচ্চবিদ্যালয়।
ভুরু কপালে উঠে গেলো নুরে ছফার। এমন রবীন্দ্রপ্রীতির গূঢ় রহস্য কি বুঝে উঠতে বেগ পেলো না। মুশকান জুবেরির ভুত মাস্টারের ঘাড়েও চড়ে বসেছে! নাকি মুশকান জুবেরির ইচ্ছে বাস্তবায়ন করেছেন রমাকান্ত মাস্টার? প্রশ্নটা ছফার মনে উদয় না হয়ে পারলো না।
স্কুলগেটটা আগলে রেখে যে দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে সে যেমন বলশালি তেমনি কঠিন। চোখেমুখে সেই কাঠিন্য ধরে রেখে যেনো জানান দিচ্ছে, এখান দিয়ে অযাচিত কেউ ঢোকার কথা স্বপ্নেও যেনো না ভাবে।
ছফা পা বাড়ালো সেদিকে। “গেট খোলো,” হুকুমের স্বরে বললো সে।
মনে হলো দারোয়ান এমন হুকুম শুনতে অভ্যস্ত নয়। চোখদুটো গোল গোল করে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “আপনে কে…কী জন্যে আসছেন?” বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে জানতে চাইলো সে।
“আমি ঢাকার ডিবি অফিস থেকে এসেছি।”
দারোয়ান সন্দেহের দৃষ্টিতে ছফাকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। “আইডিকার্ড আছে?”
কথাটা শুনে খুব অবাক হলো, তারপরও পকেট থেকে পরিচয়পত্রটা বের করে দেখালো লোকটাকে। সম্ভবত দারোয়ান এর আগে কোনো পুলিশের পরিচয়পত্র দেখেনি। ছফার আইডিটা হাতে নিয়েও সন্দেহ দূর হলো না তার।
কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলো দারোয়ান। “এই কার্ডটা যে নকল না সেইটা কেমনে বুঝুম?”
ভুরু কপালে উঠে গেলো ছফার। গ্রামের স্কুলের দারোয়ানের কাছ থেকে এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না সে। ঢাকা শহরের শিক্ষিত আর কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষজনও কখনও তার কার্ড দেখে এই প্রশ্ন করেনি। বলতে গেলে, পুরো কর্মজীবনে এই কার্ডটা হাতেগোনা মাত্র কয়েকবারই দেখিয়েছে। আর যাদেরকে দেখিয়েছে তারা বিনাবাক্য ব্যয়ে বিশ্বাস করে নিয়েছে।
“তুমি কি আমার সাথে মশকরা করছো?” দাঁতে দাঁত পিষে বললো সে।
আইডিকার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে দারোয়ান বললো, “আপনের কার্ড দেইখ্যা আমি কিছুই বুঝতে পারতাছি না, ভাই। এইটা নকলও হইতে পারে।”
অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো ছফা। লোকটা যে তাকে ভাই বলে সম্বোধন করছে সেটাও খেয়াল করেছে। তার মানে, সত্যি সত্যি সে বিশ্বাস করছে না ছফা পুলিশের লোক। অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করে বললো, “এটা তো স্কুল, নাকি?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো দারোয়ান। “হ। এখন বলেন, আপনে এইখানে কার কাছে আসছেন?”
“মাস্টারসাহেবের কাছে এসেছি…উনি আছেন না স্কুলে?”
“উনি ভিতরে আছেন…অফিসে, দারোয়ান লোকটা বললো।
“তাহলে উনার কাছে খবর পাঠাও,” আদেশের সুরে বললো সে। “বলো, ঢাকা থেকে নুরে ছফা আসছে।”
“নুরে সাফা?” দারোয়ান তার নামটা ধরতে পারলো না।
মাথা দোলালো নামের মালিক। এটা তার জন্য মোটামুটি নিয়মিত একটি ব্যাপার। প্রথমবার খুব কম মানুষজনই তার নামটা ঠিকমতো ধরতে পারে। “সাফা না, ছফা…ঠিক আছে?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো দারোয়ান, তারপরই গেটের ভেতরে ঢুকে কাউকে ডাকলো সে। ছফা দেখতে পেলো বাইশ-তেইশ বছরের এক যুবক দৌড়ে চলে এলো গেটের কাছে।
“মাস্টরসারে গিয়া বলো, ঢাকা থিইক্যা নুরে ছফা নামের এক পুলিশ আইছে…স্যারের লগে দেখা করতে চায়।”
দারোয়ানের কথা শুনেই ছেলেটা আবার দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো। “ক-দিন ধরে এখানে কাজ করো?” জানতে চাইলো ছফা।
“এই স্কুলের শুরু থেইক্যাই আমি আছি,” গর্বিত ভঙ্গিতে জবাব দিলো দারোয়ান। “দেড় বছর তো অইবোই।”
“এর আগে কোথায় চাকরি করতে?”
“এইটাই আমার পথম চাকরি।”
“তাই নাকি? তোমার ভাবসাব দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ অভিজ্ঞ এই কাজে।”
দারোয়ান কিছু বললো না।
গ্রিলের গেটটা দিয়ে ভেতরে তাকালো ছফা। জমিদার বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণটি বেশ বদলে গেছে। মাঝখানে যে ফোয়ারাটা ছিলো সেটা আর নেই। সবুজ ঘাসের জায়গাটি এখন ইট বিছানো একটি চত্বর। জমিদার বাড়ির সেই পুরনো ভবনটিও নেই, সেখানে গড়ে উঠেছে একতলার একটি টিনশেড ভবন।
ছফার মনে পড়ে গেলো তিন বছর আগে এক রাতে কিভাবে সে দেয়াল টপকে এখানে ঢুকেছিলো, ফোয়ারাটার কাছে এসে ঘাপটি মেরে ছিলো কিছুক্ষণ। রোমাঞ্চকর একটি অভিযান ছিলো সেটা। গল্প করার মতোই ঘটনা। কতোটাই না ভড়কে গেছিলো ভবনের পেছনে, জোড়পুকুরের পাশে মাটি চাপা দেবার দৃশ্যটা দেখে। তারপর মুশকান জুবেরির সেই চাহনি, দ্রুত ঝোঁপের আড়াল থেকে পালিয়ে…
“আসেন।”
দারোয়ানের কথায় স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে এলো সে।
“স্যার আপনেরে ভিতরে যাইতে বলছেন।”
ছফা মুচকি হাসি দিয়ে গেটের ভেতরে পা রাখলো। সেই বিশ-বাইশ। বছরের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি নিয়ে, সম্ভবত তার পুলিশ পরিচয়ের কারণে।