“সব মিছা কথা!” প্রতিবাদ করে উঠলো টঙ দোকানি। “এইসব কথা ক্যাঠায় কইছে তুমারে?”
“আরে, আমি সব খবরই রাখি। তুমি হিটলুর কাছ থিকা কমিশন পাও।”
বিস্মিত রহমান মাথা দোলালো। ছফার দিকে ফিরে তাকালো সমর্থন পাবার আশায়, “ছার, বিশ্বাস করেন মিছা কথা–”
হাত তুলে থামিয়ে দিলো নুরে ছফা। আতর আলীর দিকে তাকালো সে, “এসব বাদ দাও তো।” তারপর আবার দোকানির দিকে ফিরলো, “এক প্যাকেট বেনসন দিন।”
রহমান মিয়া ঝটপট সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলো ছফার দিকে, তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়লো চা বানাতে। কমিশনের আলাপ থেকে মুক্ত হতে চাইছে যেনো।
একটা সিগারেট ঠোঁটে নিতেই আতর আলী নিজের পকেট থেকে লাইটার বের করে বাড়িয়ে দিলো। মুচকি হেসে সিগারেটটা ধরালো ছফা।
রহমান মিয়া গুঁড়ের চা বানিয়ে দুজনের দিকে বাড়িয়ে দিলে নিজের কাপটা হাতে নিয়ে চুপচাপ চায়ে চুমুক দিতে শুরু করলো ছফা। আতরের দিকে আড়চোখে তাকালো একবার। জোরে জোরে চুমুক দিয়ে চা-টা দ্রুত শেষ করে উঠে দাঁড়ালো ইনফর্মার।
“স্যার, আমি তাইলে যাই,” ছফার উদ্দেশ্যে বললো। “আমার একটা কাম আছে টাউনে।”
“আচ্ছা। পরে দেখা হবে।”
পকেট থেকে টাকা বের করে রহমান মিয়াকে দিয়েই চুপচাপ বাইকটা স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো আতর।
“এখনকার এমপি মানুষ হিসেবে কেমন?” ইনফর্মার চলে যাবার পর রহমান মিয়াকে জিজ্ঞেস করলো ছফা।
“মানুষ ভালাই, তয় বয়স অনেক কম,” জানালো দোকানি। “আসাদুল্লাহ যহন বাঁইচ্যা আছিলো তহন হে সুবিধা করবার পারে নাই। মামলা-মুমলা দিয়া বহুত পেরেসানে রাখছিলো…তহন হে ঢাকায় থাকতো। ফেরাউনটা মরনের পর গেরামে ঢুকছে, তারপর কেমনে কেমনে এমপিও হইয়াও গেলো। সবই কপাল।”
“তারা দু-জন কি একই পার্টি করতো না?” সিগারেটে টান দিয়ে জানতে চাইলো ছফা।
“হ, একই পার্টি করতো কিন্তু বনিবনা আছিলো না। আসাদুল্লাহ এন্টি পাটির লুকজনরে যিমুন পেরেসানিতে রাখতো, নিজের পাটির অনেরেও দৌড়ের উপর রাখছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “শুনলাম মাস্টারের সাথে নাকি নতুন এমপির খুব খাতির?”
“হ। জোনায়েদভাই তো মাস্টরের কাছে ছুটকালে পড়ছে…খুবই মাইন্যগণ্য করে তারে।”
“মাস্টারের এখন কী অবস্থা?”
“সুন্দরপুর তো এহন মাস্টরই চালায়,” হেসে বললো রহমান। “পুলিশ-ডিচি-এচপি-টিনও, সব হের পকেটে থাহে। আমাগো নয়া এমপিও হের কথায় উঠে আর বহে।”
ছফী বুঝতে পারলো আবারো ক্ষমতাধর একজনকে মোকাবেলা করতে হবে তাকে। তবে এদের চেয়েও প্রবল ক্ষমতাধর মানুষ আছে তার মাথার উপরে। বাধাবিপত্তি যতোই আসুক না কেন, সব কিছু সামলাবে ঐ লোক। যদিও স্থানীয় ক্ষমতাবানদের কিছু সুবিধা থাকে। অনেক সময় তাদেরকে ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে ওঠে না। তাই ছফাকে এবারও সতর্ক থাকতে হবে।
“তয় মাস্টর মাটির মানুষ, হে আগের মতোই আছে,” বললো। দোকানি। “চাইলে, সুন্দরপুরে যা খুশি করবার পারে কিন্তু স্কুল আর লাইবেরি লইয়াই পইড়া থাহে সারা দিন, কারো আগে পিছে কুনোকালেই হে ছিলো না, এহনও নাই।”
কথাটা মেনে নিতে কষ্টই হলো ছফার। মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার আগে এই ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে কথা বলেছে। তার ধারনা, এখনও এই লোকটার সাথে মহিলার কোনো না কোনো যোগাযোগ আছে-তবে সেটা
তিনি করেন খুবই সঙ্গোপনে। ভদ্রলোক নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করার ব্যাপারে খুবই সচেষ্ট থাকেন।
“মাস্টরের স্কুল খালি আমাগো গেরামেই না, বাইশ গেরামের মইদ্যে সেরা।”
রহমান মিয়ার কথায় সম্বিত ফিরে পেলো ছফা।
“বাপ-মায়েরা পোলাপান নিয়া আইস্যা পড়ে মাস্টরের কাছে। ছার, আমার পোলাটারে মানুষ কইর্যা দেন…ওরে আপনের কাছেই দিয়া গেলাম।” দোকানি এমনভাবে কথাটা বললো যেনো ঘটনাগুলো তার চোখের সামনেই ঘটে। “স্কুলের আবার হুস্টেলও আছে। এত্ত বড় জমিদার বাড়ি…জায়গার অভাব আছেনি?”
কপট প্রশংসার অভিব্যক্তি ফুটে উঠলে ছফার মুখে। “স্কুল দিতে না দিতেই এতো সুনাম!”
“স্কুল নতুন হইবার পারে, মাস্টর তো নতুন মানুষ না। হেরে চেনে না এমুন মানুষ আছে এই এলাকায়? পোলাপানগো হে গানও শিখায়, ছবি আঁকায়…কত্তো কী যে করায়। ঢাকা-কলিকাতা থেইক্যাও মাস্টর নিয়া আসছে। এলাহি কাজ-কারবার।”
নুরে ছফা উঠে দাঁড়ালো। “আসলেই বিরাট কাজকারবার।”
ছফার কথাটার সুর বুঝতে পারলো রহমান। এই লোক যে মাস্টারকে খুব একটা পছন্দ করে না, সেটাও তার অজানা নয়।
“কতো হয়েছে আমার?” চওড়া হাসি দিলো দোকানি। “আতর তো বিল দিয়া দিছে।”
“ওহ্।” ছফা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে টঙ দোকান থেকে পা বাড়ালো রাস্তার দিকে।
রহমান ঘাড় উঁচু করে সেদিকে চেয়ে রইলো। রাস্তা পার হয়ে নতুন স্কুলটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নুরে ছফা।
“মাস্টারের কথা শুনলে তো মুখ কালা হয়া যায়,” বিড় বিড় করে বললো দোকানি। “আবার দেহি হের কাছেই যায়!”
২০. অনেক কিছু বদলে গেছে
অধ্যায় ২০
প্রায় তিন বছর পর এলেও পথটি তার ঠিকই মনে আছে। যদিও অনেক কিছু বদলে গেছে এই সময়ে।
রবীন্দ্রনাথের পাশ দিয়ে যে মেঠো পথটি চলে গেছিলো জমিদার অলোকনাথ বসুর পৈতৃক বাড়ির দিকে, সেটা এখন পাশাপাশি দুটো রিক্সা যেতে পারে এমন প্রশস্ত পিচঢালা পথ। খুব বেশি হলে এক বছরের পুরনো হবে রাস্তাটি। পথের দু-ধারে কিছু দিন আগে লাগানো হয়েছে গাছের চারা, সেগুলো ছোটোছোটো গোলাকার বাশের বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত।