যাই হোক, হোটেল থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতেই সে চলে এলো রবীন্দ্রনাথ আর মুশকানের সামনে। পথের দু ধারে দুটো রেস্টুরেন্টে এই সাত সকালেও কাস্টমারের বেশ সমাগম হয়েছে। আতরের কাছ থেকে এখানকার খাবারের বেশ সুনাম শুনেছে সে। দেখেও মনে হচ্ছে, এদের খাবার-দাবার শুধু সুস্বাদুই নয়, বেশ স্বাস্থ্যসম্মতও হবে-যদি তারা মুশকান জুবেরিকে সত্যি সত্যি অনুকরণ করে থাকে তো!
হাতঘড়িতে সময় দেখলো ছফা, এখনও বিশ-পঁচিশ মিনিট সময় হাতে আছে। গতকালের নামবিহীন খাবারের দোকানে নাস্তা করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। তাছাড়া, দুটো রেস্টুরেন্ট থেকে যে ঘ্রাণ ভেসে আসছে সেটা তার ক্ষিদেটাকে চাগিয়ে দিচ্ছে। নিজেকে প্রবোধ দিলো-নামে কী আসে যায়! রেস্টুরেন্ট দুটোর মালিক ব্যবসায়িক দিক মাথায় রেখে নামদুটো নিয়েছে, এর সাথে আগের রেস্টুরেন্ট কিংবা তার মালেকিনের কোনো সম্পর্ক নেই। অগত্যা, অনেকটা হুট করেই সে ঢুকে পড়লো মুশকানের ভেতরে!
রেস্টুরেন্টের প্রায় সব সিটই দখল করে রেখেছে ভোজন রসিকেরা, তারপরও একটা সিট খালি পেয়ে বসে পড়লো সে। ওয়েটারকে দ্রুত অর্ডার দিলে নাস্তার জন্য-সজি, রুটি আর ডিম ভাজি, সেই সাথে এক কাপ চা।
রবীন্দ্রনাথের খাবারের মতো সুস্বাদু না-হলেও মুশকানের স্বাদ বেশ ভালো। তৃপ্তি নিয়েই খেলো নুরে ছফা। ঝটপট নাস্তা সেরে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ এগোতেই একটা শব্দ শুনে পেছনে ফিরে তাকালো সে।
আতর আলী বাইক নিয়ে চলে এসেছে। বাইক থামিয়ে হাসিমুখে বললো ইনফর্মার, “নাস্তা করতে আইছিলেননি?”
সত্যিটা বলবে কিনা বুঝতে পারলো না ছফা, কিন্তু সে কিছু বলার আগেই আতর আবার বলে উঠলো।
“এগোর খাওন-দাওন কিন্তু মাশাল্লাহ। কিন্তু ভুলেও ইমামুদ্দির হোটেলে খায়েন না…হাতে এক্কেবারে লোটা ধরায়া দিবো।”
ইমামুদ্দির ব্যাপারে আতর আলীর কথাটা যে সত্যি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে গত রাতে।
“দেখছেন, সকাল সকাল পীপড়ার মতো ভীড় লাইগ্যা গেছে, রাস্তার দু-পাশে রেস্টুরেন্ট দুটোর দিকে ইঙ্গিত করে বললো ইনফর্মার। “এইহানেই খাওন-দাওন কইরেন। আমি ফজলুরে
“এটা কবে কিনলে?” প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বাইকটার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলো ছফা।
“কিনছি তত তিন মাস হইলো। আমাগো টাউনের সেকান্দার মিয়ার আছিলো এইটা, ওর আবার ট্যাকার খুব দরকার পড়লো…আমারে কইলো, দোস্ত, কিছু টাকা দেও…হুন্ডাটা রাখো। আমি দেখলাম, এতো সস্তায় এই জিনিস আর পামু না, তাই কিইন্যা ফালাইলাম।” নিজে থেকেই বাইক কেনার গল্পটা বলে গেলো আতর।
ছফা চাচ্ছে না, এইসব বানোয়াট গল্পের পরিসর আরো বাড়ুক। “চলো, আমাদের কাজে নেমে যেতে হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
দাঁত বের করে হেসে ফেললো ইনফর্মার। “উইঠ্য পড়েন, স্যার।” ছফা চুপচাপ উঠে বসলো আতরের বাইকের পেছনে।
ইনফর্মারের চোখেমুখে গর্বিত ভঙ্গি ফুটে উঠলো। এলাকার অনেকেই দেখবে, ঢাকা থেকে আসা মহাক্ষমতাধর পুলিশ অফিসার তার বাইকের পেছনে বসেছে।
সুন্দরপুরের মহাসড়ক দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আতরের বাইকটা চলে এলো রহমান মিয়ার টঙ দোকানের সামনে।
“অনেকদিন বাদে আইলেন…আছেন কিমুন?” তাকে দেখে গদগদ হয়ে বললো দোকানি।
“আছি ভালোই। আপনি কেমন আছেন?” ছফা বাইক থেকে নেমে জানতে চাইলো।
দাঁত বের করে চওড়া একটা হাসি দিলো রহমান। “আছি আর কি…গরীব মানুষ।”
আতরের চোখমুখ বিরক্তিতে সামান্য কুঁচকে গেলো। টঙের সামনে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লো ছফা।
“তা, এতোদিন পর আইলেন যে, কিছু হইছেনি আবার?”
“দুই কাপ চা বানাও, মিয়া, বাইকটা স্ট্যান্ডের উপর রাখতে রাখতে বললো আতর। তার চোখেমুখে বিরক্তি। “খালি বেশি কথা কও।”
রহমান আর কিছু না বলে চা বানাতে মনোযোগি হলো। “আপনার ব্যবসা কেমন যাচ্ছে?” জানতে চাইলো ছফা।
রহমান মিয়া মুখ কালো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আর ব্যবসা! ঐ হুটেল বন্ধ হওনের পর আমার ব্যবসা উঠছে চাঙ্গে।” রবীন্দ্রনাথের দিকে ইঙ্গিত করলো। “এহন তো এইদিকে কেউ খাইতে আহে না, যারা আহে তারা সব পণ্ডিত, খালি বই পড়ে।”
আতর আলী ছফার পাশে এসে বসলো। “বেটির হোটেলটারে তো দুই চক্ষেও দেখবার পারতা না, ওইটা যখন বন্ধ হয়া গেলো ঈদের মতো খুশি হইছিলা, এহন আবার এই গীত গাইতাছছা ক্যান, মিয়া।”
বিরক্ত হয়ে তাকালো রহমান। “আমি খুশি হইছি তুমারে কে কইলো? খালি আজাইরা কথা!”
ইনফর্মার দাঁত বের করে হাসলো।
“আপনি নতুন রেস্টুরেন্ট দুটোর পাশে টঙটা সরিয়ে নিলেই পারেন, বললো ছফা। “ওখানে তো ভালো কাস্টমার পাবেন।”
রহমান কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আতর আলী কথা কেড়ে নিলো। “আপনে ওরে যতো বোকা ভাবেন ওয় আসলে অতো বোকা না, স্যার। ইচ্ছা কইরা এইহানে পইড়া আছে। এতো সহজে ওইখানে যাইবো না।”
রহমান মিয়া ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো আতরের দিকে।
অবাক হলো ছফা। “কেন?”
“এইহানে থাকলে তো বইসা বইসা কামাইতে পারে, বুঝলেন না?”
“কি কও এইসব?” প্রতিবাদ করে উঠলো দোকানি।
বিজ্ঞের মতো হাসি দিলো ইনফর্মার। “মনে করো আমি কুনো খবর রাখি না,” তারপর গর্বিত ভঙ্গিতে ছফার কাছে বয়ান করলো সে, “হিটলুর লগে হের হট টেরাম, বুঝলেন? হেয় ওরে কইছে, খিচ মাইরা যেইহানে আছো সেইহানে পইড়া থাকো, রহমান। শহর থিকা লোকজন বেটির হোটেলের খুঁজ করলে তুমি আমার নতুন হোটেলটার কথা কইবা। ফজলুরটা নকল…আমারটা আসল।”