“ইটস ওকে,” মিষ্টি করে হেসে বললো ডাক্তার লুবনা। নিজের বিরক্তি আর রাগ হজম করে ফেলেছে পুরোপুরি, মুখে এখন সৌজন্যতার হাসি।
“নুরে ছফা হইলেন ডিবির সবচায়া ব্রিলিয়ান্ট অফিসার…অনেক কঠিন কেস সল্ভ করছেন,” মেয়েটাকে বললো মি. খান।
ছফা অবাক হয়েই লক্ষ্য করলো, এমন সুন্দরী তরুণীর সান্নিধ্যেও কেএস খান সাবলীল ভঙ্গিতে চলভাষায় কথা বলছে।
ডাক্তার লুবনা যেনো একটু স্মৃতি হাতরে নিলো। “হুম, মনে পড়েছে…আপনি বলেছিলেন, মিস্ট্রিয়াস লেডি মুশকান জুবেরির কেসটা সল্ভ করেছিলেন,” মেয়েটার চোখেমুখে এখন প্রশংসার অভিব্যক্তি।
কেএস খান হাসি হাসি মুখ করে সায় দিলো।
“আপনার ঐ কেসটার কথা শুনেছি মি. খানের কাছ থেকে,” এবার আন্তরিকমাখা হাসি দিয়ে ছফাকে বললো তরুণী। “খুবই ইন্টারেস্টিং ছিলো, একেবারে ভয়ঙ্কর কোনো সিনেমার মতোই!”
নুরে ছফা মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করলো। কেসটা যে সে পুরোপুরি সল্ভ করতে পারেনি সেটা আর বললো না। তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা- মেয়েটার সাথে কেএস খানের সম্পর্ক কী?
ভাগ্নি? ভাতিজি?
বান্ধবী??
“আমি ডাক্তার লুবনার রুগি,” যেনো ছফার প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে দিলো কেএসকে। কথাটা বলেই বোকার মতো হাসলো ভদ্রলোক। “আমার যে কন্ডিশন…রেগুলার তার কাছে যাইতে হয়।”
“আমি অবশ্য উনাকে রোগী হিসেবে দেখি না। আই থিঙ্ক উই আর ফ্রেন্ড,” বললো সেই লাস্যময়ি তরুণী।
ছফার ভুরু অনিচ্ছাকৃতভাবেই কপালে উঠে গেলো। বান্ধবী?
কেএস খানের মুখে বোকা বোকা হাসি, আর সেটা ঝুলে রইলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। “ডাক্তার আমারে জোর কইরা নিয়া আসলো এইখানে।” কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বললো সে।
অবশ্য লাল টকটকে পাঞ্জাবি আর চপ্পল দেখে ছফার মনে হচ্ছে না ‘জোর’ শব্দটা এখানে খাটে। যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে চলে এসেছে মি. খান।
“তা, আপনের খবর কি, ছফা? অনেক দিন কোনো খোঁজখবর নাই।”
প্রায় দু-মাস হলো মি. খানের সাথে তার দেখা হয়নি। ডিবির অন্য অফিসারদের মতো কোনো কেসে নাকানি চুবানি খেলেই সাবেক এই ইনভেস্টিগেটরের শরণাপন্ন হয় না ছফা। এলিভেটরের ভেতরে অদ্ভুত এক খুনের ঘটনা আর মুশকান জুবেরির কেসের বেলায় পরামর্শ, সাহায্য বাদ দিলে বিগত কয়েক বছরে মি. খানের কাছে কোনো কেস নিয়ে যায়নি সে। তবে ডিপার্টমেন্টে ক্রিমিনোলজির ক্লাস নেবার সময় তাদের মধ্যে দেখাসাক্ষাত হয়। সেটাও দু-মাস ধরে বন্ধ আছে ছফার অফিস অন্যত্র সরিয়ে নেবার কারণে। ডিবি অফিস এখন মিন্টো রোড থেকে ইস্কাটনের নতুন একটি ভবনে বর্ধিত করা হয়েছে। পুরনো ভবনে কেএস খান এখনও ক্লাস নেয়।
“এই তো, স্যার…” বললো সে। “একটু ব্যস্ত আছি কিছু কে নিয়ে।”
“বাসায় আইসেন, এক কাপ চা খায়া যায়েন। অনেক দিন আলাপ হয়।”
“আসবো, স্যার।”
“এই সপ্তাহে কোনো ক্লাস নাই…ফ্রি আছি। আপনে চইলা আইসেন।”
“ঠিক আছে, স্যার।”
ডাক্তার লুবনা হাতঘড়ি দেখলো। “মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়ে যাবে, কেএস খানকে মৃদু তাড়া দেবার সুরে বললো সে।
বিব্রত হাসি দিলো সাবেক ডিবি অফিসার।
ছফা যারপরনাই বিস্মিত। মি. খান এক সুন্দরী তরুণীকে বগলদাবা করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাবেন?
না। নিজেকে শুধরে দিলো। মেয়েটাই কেএস খানকে বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছে।
“ঠিক আছে, স্যার…আমি যাই, পরে কথা হবে,” বললো ছফা। ডাক্তার লুবনার দিকে চেয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিলো।
বিদায় নেবার সময়ও বিব্রতকর হাসিটা লেগে রইলো কেএস খানের মুখে। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারলো, মি. খানকে মনে মনে হিংসাই করছে সে। ডিভোর্সি এই ভদ্রলোক নিশ্চয় মেয়েটার সাথে হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার ভেতর থেকে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত ছফার জীবনে সেভাবে কোনো নারীর অনুপ্রবেশ ঘটেনি। কী কারণে সে নিজেও জানে না।
তার রুক্ষ্ম ব্যবহার কর্মজীবনের ব্যস্ততা? নাকি মানবীয় সম্পর্কের ব্যাপারে তার উসীনতা?-ছফা জানে না।
সম্বিত ফিরে পেতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে রমনার উদ্যান থেকে বের হয়ে শিশুপার্কের দিকে যে অস্তাচল নামে গেটটা আছে, সেখানে চলে এসেছে কখন টেরই পায়নি। এখান থেকে কোথায় যাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না।
বাড়ি ফিরে যাবে? সারাটা দিন নিজেকে বন্দী করে রাখবে ঘরে? নাকি লক্ষ লক্ষ ঢাকাবাসির মতো বৈশাখের প্রথম দিনটি পথেঘাটে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘোরাঘুরি করেই কাটিয়ে দেবে?
অবশেষে বাড়ি ফিরে যাবার সিদ্ধান্তই নিলো। আরেকটু হেঁটে শাহবাগের মোড়ে গিয়ে রিক্সা নেবার জন্য পা বাড়ালো সে। পথেঘাটে মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে খুব দ্রুত। আরেকটু পরই এই পথঘাট জনস্রোতে তলিয়ে যাবে। উপর থেকে দেখলে মনে হবে পথের উপর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে নানান রঙের ছটা।
নুরে ছফা মানুষজনের ভীড় এড়ানোর জন্য ফুটপাত থেকে পথে নেমে পড়লো। জনসাধারণের সুবিধার্থে এই রাস্তাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে যানবাহন প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
রোদের উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য সানগ্লাসটা বের করে পরে নিলো সে, সেই সাথে একটা সিগারেটও বের করে নিলো প্যাকেট থেকে। হাঁটতে হাঁটতেই লাইটার দিয়ে আগুন ধরালো। প্রচণ্ড রোদে উত্তপ্ত ধোয়া টেনে নিলো বুকে।