হিটলু একটু কাচুমাচু খেলো। নামের এই বুদ্ধিটা সে পেয়েছিলো মাস্টারের দেয়া নতুন লাইব্রেরির ভেতরে রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে একটি লেখা থেকে। কবি যে এই সুন্দরপুরে কখনও আসেননি সেটা নিয়েই ছিলো লেখাটা।
“কিন্তু শহর থেইক্যা যে আইছে, তারে যদি তুমি এইসব কইতে যাও…” কথাটা শেষ না করে ঢুলু ঢুলু চোখে চেয়ে রইলো শিকারের দিকে।
হিটলু একটু ভেবে নিলো। “ভাই, তার লগে তো আপনের বহুত খাতির, আপনে একটু দেখেন না ব্যাপারটা?”
আতর আলী বাঁকাহাসি দিলো। “সব কিছু আমি দেখুম ক্যান? আমার কি ঠ্যাকা পড়ছে, অ্যাঁ?”
রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি’র মালিক একটু কাছে এগিয়ে এলো। “আপনের দিকটা আমি দেখুম, ভাই। আপনে খালি আমার দিকটা একটু দেখেন।”
আতর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো।
“হাজার দুয়েক দিমুনে, ঠিক আছে?”
কৃত্রিম আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো ইনফর্মার। “এতো হিটলারি বুদ্ধি মাথায় রাখো আর এইটা বোঝো না, এই কাম দুই-তিনে হইবো না?”
চেহারাটা মলিন করে ফেললো হিটলু।
“তুমি আসলেই একটা খাইষ্টা,” বোতলটা আবার তুলে নিলো হাতে, ঢক ঢক করে পান করলো। “তোমার চায়া ফজলু অনেক চিকন বুদ্ধি মাথায় রাখে, দিলদরিয়াও আছে। তারে আমি কিছুই বলি নাই, নিজ থেইক্যাই পাঁচ দিয়া গেলো।”
একটু গাল চুলকে নিলো হিটলু। “হেয় তো দাগি আসামির নামে হোটেল দিসে…বেশি দিবারই পারে।”
চোখমুখ খিচে ফেললো আতর। “হে দাগি আসামির নামে দিছে, আর তুমি নাটকিরপোলা ঐ আসামির হোটেলটার নামই মাইরা দিছো। ক্রিমিনাল তো কেউ কারোর চায়া কম না।”
হিটলু একটু ভেবে নিলো। “তাইলে আমিও পাঁচ দিমুনে, কী ক?” কথা আর বাড়াতে চাইলো না সে।
“এতোক্ষণে লাইনে আইছো, বোতলটা পাশে রেখে দিলো আবার। “এই জিনিস খালি খাইতে ভাল লাগে না, বুঝছো?”
হিটলু কিছুই বললো না।
“তোমার হোটেলের গরুর ভুনা তো ফেমাচ…একটা পোলারে দিয়া এক প্লেট পাঠায়া দিও এইখানে।”
“আচ্ছা, ভাই।”
“আর ট্যাকাটা কাইলকার মইদ্যে দিতে হইবো, তেড়িবেড়ি করবা না।” মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে গেলো হিটলু।
আতরের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। একটু পর ফজলু আসবে, তাকেও একই কথা বলবে। পাঁচ পাঁচ দশ! এক দানে এতোগুলো টাকা পাবার পর গঞ্জে যাবে সে খুব জলদি। গত সপ্তাহে শেফালি নামের নতুন যে মেয়েটা এসেছে, ঐ শালি সুন্দরপুরের আশেপাশে যতো লুঙ্গি আর গামছার বেপারী আছে, সব শালাকে যেনো গলায় গামছা বেঁধে টেনে আনছে। খুব ডিমান্ড তার। আর এবার তার ডিমান্ড মেটাবে!
বোতলটা তুলে নিয়ে লম্পট ঠোঁটটা ছোঁয়ালো, আবারো পান করলো ঢক ঢক করে।
.
অধ্যায় ১৯
ভ্রমণের ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও রাতে ভালো ঘুম হলো না ছফার। সুরুত আলীর নোংরা আর জঘন্য আবাসিক হোটেলকে এজন্যে দায়ী করা যায় না। বৈশাখ মাসের খামখেয়ালি আবহাওয়া এমনই যে, বিকেলের ঝড় সন্ধ্যার পর পরই উধাও হয়ে যায়, রাতের বেলায় সুন্দরপুরে নেমে আসে ভ্যাপসা গরম। ওদিকে হোটেলের পাশে সদ্য দেয়া জনপ্রিয় দুটো রেস্টুরেন্টের খাবার পরিহার করার মাশুলও দিতে হয়েছে তাকে। নামবিহীন এক খাবারের দোকানের খাবার খেয়ে পেট ফেঁপে গেছিলো তার। এটাই তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।
ভোরের দিকে ক্লান্তি থেকে আসা ঘুম ভাঙলো সকাল নয়টারও পরে। তারপরও বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। গতকাল রাতে এই হোটেলে ওঠার আগে আতরের সাথে একটা জরুরী কাজ নিয়ে আলাপ করেছে সে। তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে, বেশ সতর্কতার সাথে কাজটা করতে হবে, একদমই সময় নষ্ট করা যাবে না।
“এইসব কাম তো আমি কবেই ছাইড়া দিছি,” অপারগতা প্রকাশ করে বলেছিলো ইনফর্মার। “তয় চিন্তা কইরেন না, অন্য একজরে দিয়া করামুনে।”
“আরে না,” সঙ্গে সঙ্গে ছফা বলে উঠেছিলো। সে চায়নি অন্য কেউ এ কাজ করুক। গোপন জিনিস যত কম জানা যায় ততো ভালো। “যাকে তাকে দিয়ে এ কাজ করানো যাবে না…বুঝতে হবে এটা। “
“ওয় আমার হাতের মুঠিতে থাকে,” আশ্বস্ত করে বলেছিলো ইনফর্মার। “ওরে নিয়া কুনো চিন্তা কইরেন না, স্যার।”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ছফা জানতে চেয়েছিলো, “কে সে?”
“বল্টু। আমাগো সুন্দরপুরের আলী বাবা! চল্লিশ চোরের কাম একাই করবার পারে সে। কব্বরে গেলেও এই কথা কাউরে কইবো না।”
মাথা নেড়ে সায় দিলেও সন্দেহটা পুরোপুরি যায়নি ছফার।
“কিন্তু লোকটা যদি ধরা পড়ে যায়?”
“লোক না তো…পোলা,” শুধরে দিয়ে বলেছিলো আতর। “ওর বয়স চৌইদ্দ-পরো অইবো।”
“কি!” অবাকই হয়েছিলো সে। “তুমি একটা পিচ্চিকে দিয়ে এরকম কাজ করাবে?”
“বয়সে পিচ্চি হইলেও ওর মতো সেয়ানা এই সুন্দরপুরে দুইটা নাই। এই বয়সেই খানকি পাড়ায়…” কথাটা শেষ না করে আবার বলে, “আপনে যেইটা চাইতাছেন ওইটা বই করবার পারবো। মাইনষের ভীড়ে কাম সাইরা ফালায় সে, আর এইটা তো খালি বাড়ি…ওর কাছে ডাইলভাত।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলো ছফা।
আতর আলী দাঁত বের করে হেসে বলে, “তাইলে ধইরা লন, আপনের কাম হয়া যাইবো।”
এখন বিছানা থেকে নিজেকে জোর করে তুলে নিয়ে টয়লেটে চলে গেলো ছফা। সে টের পেয়েছে, এই হোটেলে ওঠার সাথে সাথে এখানকার ‘ব্যবসায় মন্দাভাব শুরু হয়ে গেছে। নতুন ম্যানেজারের বেজার করা মুখ দেখে বুঝতে পেরেছে, তার উপস্থিতি যতো প্রলম্বিত হবে এই মুখ ততোই চুপসে যেতে থাকবে। নিশ্চয় ভদ্রলোককে সাবধান করে দিয়েছে আতর।