সিগারেটে আয়েশ করে টান দিচ্ছে আতর। একটু আগে নুরে ছফাকে হোটেল সানমুনে রেখে এসেছে, তখন বিস্তারিত কথা হয়েছে তার সাথে। তাকে যে কাজ করতে বলেছে সেটা খুবই অবমাননাকর। তবে সমস্যা নেই, সব ধরণের কাজের জন্যই মানুষ আছে এই দুনিয়াতে। একটু আগে আতর সেরকম একজনকে খবরও দিয়েছে। তারপরই তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দুটো কল দেয় সে। এখন সেই দু-জন মানুষের অপেক্ষায় আছে।
পনেরো-ষোলো বছরের এক কিশোর এলো এ সময়। মলিন জিন্স আর টি শার্ট গায়ে। তার হাতে একটা ব্যাগ।
আতরের কাছে এসে চুপচাপ সালাম ঠুকে ব্যাগটা দিয়ে দিলো তাকে, সেই সাথে পকেট থেকে কিছু টাকাও। টাকাগুলো না শুনেই পকেটে ভরে নিলো সে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে সেখান থেকে বের করে আনলো কেরু অ্যান্ড কেরু কোম্পানির একটি বোতল।
“কতত দিছোস?”
“দুইশো।”
“আইজকা আমদানি এতো কম ক্যারে, হারামজাদা?”
গালিটা গায়েই মাখলো না কিশোর, যেনো হররোজ এরকমটা শুনতে হয় তাকে। “আইজ তো টাউনের বাইরে যাই নাই।”
“ক্যান, আলেকবর মেম্বারের মাইয়ার না বিয়া হইতাছে…ওইখানে যাস নাই?” সন্দেহের সুরে জানতে চাইলো সে।
মলিন মুখ করে মাথা দোলালো কিশোর। “ওই বাড়ির বেবাক্তে আমারে চিনে, গেলেই ধরা খামু।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো আতর। বয়স কম হলেও ছেলেটা যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন। “কাইলকার কামটা কিন্তু টাইম মতোন করন লাগবো, মনে থাকে যে। একটু এদিক ওদিক হইছে তো পুটকি দিয়া বাঁশ ঢুকামু।”
মাথা নেরে সায় দিলো ছেলেটা। “ওইটা নিয়া আপনে এটুও টেনশন নিয়েন না, ওস্তাদ।”
আতর রেগেমেগে তাকালো। “ওই হালারপুত, আমারে ওস্তাদ কস্ ক্যান?” হারুকাটা মারা যাবার পর এই পিচ্চি কিছু দিনের জন্য ওস্তাদ বানিয়েছিলো গঞ্জের কাঙ্গালি মজিদকে-বছর গড়াতে না গড়াতেই মজিদও পটল তুলেছে কম দামি স্পিরিট পান করে। সেই থেকে আতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর যাই হোক, বল্টুর ওস্তাদ হওয়া যাবে না!
গাল চুলকালো ছেলেটা। ইনফর্মারের রাগের কারণটা ধরতে পারলো না। “কিন্তু এহন তো আপনেই আমার–”
কথার মাঝখানে হাত তুলে থামিয়ে দিলো ছেলেটাকে। “আমি তোর বস্…ওস্তাদ না। কথাটা খিয়াল রাখবি। এহন যা।”
চুপচাপ চলে গেলো ছেলেটা।
প্রথম সিগারেটটা যখন প্রায় শেষ তখনই পরিত্যক্ত বাড়িতে ঢুকলো হ্যাংলা মতোন এক লোক। তার পরনের জামা-কাপড় অবশ্য পরিপাটি। চুলগুলো বেশ ছোটো করে ছাটা। পাতলা গোঁফেও যত্নের চিহ্ন সুস্পষ্ট।
“সালাম, আতর ভাই।”
বোতলটা পাশে রেখে নিঃশব্দে সালামের জবাব দিলো ইনফর্মার। আগে এই বেয়াদপটা তাকে সালাম দিতো না, কিন্তু এখন শুধু সালামই দেয় না, সম্ভ্রমও করে আর সেটা অবশ্যই ভয় থেকে।
সবই হলো ক্ষমতা। এটা থাকলে মেথরও রাজা, না থাকলে রাজাও মেথর।
“কিছু হইছেনি? এতো জরুরী তলব করলেন যে?”
বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো আতরের ঠোঁটে। এ ধরণের কাজের সময় তার ভাবভঙ্গি একটু বেশি নাটকীয় হয়ে যায়। “ট্যাকা কামাইতে কামাইতে তো আন্ধা হয়া গেছো…সুন্দরপুরে কী হইতাছে না হইতাছে, কুনো খবর রাখো?”
লোকটা কিছুই বুঝতে পারলো না, চেয়ে রইলো ইনফর্মারের দিকে।
“উনি তো আবার আইছেন!” গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে বললো। “এহন কী করবেন কে জানে!”
“কার কথা কইতাছেন?” অবাক হলো হ্যাংলা মতোন লোকটি।
“যার ডরে তোমাগো ম্যাডাম হোগার কাপড় মাথায় তুইল্যা সব ফালায়া-ফুলায়া পলাইছিলো।” একটু থেমে আবার বললো, “তোমার হিটলারি মাথায় এহনও ঢুকতাছে না, হিটলুমিয়া?”
লোকটা ঢোঁক গিললো আলগোছে। “আবার কী হইছে?”
চোখ কপালে তুললো আতর। “কী হইছে মাইনে?” আক্ষেপে মাথা দোলালো। “এহনও বুঝবার পারো নাই?” পাশ থেকে বোতলটা তুলে নিয়ে মুখটা খুলতে শুরু করলো সে। “বেটির নামটা তো পুরা মাইরা দিয়া বইয়া আছো…এইবার ঠ্যালা সামলাও!” বোতল থেকেই দুই ঢক পান করে গলাটা ভিজিয়ে নিলো। কেরু মদের তেঁতো স্বাদে সাময়িক চোখমুখ কুঁচকে ফেললো সে। “স্যারে আমারে কইছে, ঐ ডাইনি পলানোর পর কার এতো বড় সাহস হইলো, তার হোটেলটা আবার দিছে!”
হিটলু বোঝার চেষ্টা করছে আতরের কথার মমার্থ।
“তুমাগো দুইজনের লুঙ্গি তুইল্যা পলানোর টাইম হয়া গেছে, বুঝলা?” বোতলটা পাশে রেখে দিলো ইনফর্মার।
“ভাই, আমরা কী অন্যায়টা করছি, ক? চুরি চামারি তো করি নাই, কর্ম কইরা খাইতাছি।”
কথাটা আতরের আঁতে ঘা বসালো। মনে হলো তাকেই ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে। একে তো সাবেক চোর, তার উপরে এই জীবনে নির্দিষ্ট কোনো কাজকর্ম করেনি কখনও। আর পুলিশের ইনফর্মারগিরি যে কোনো পেশা নয়, সেটা কে না জানে।
“চুরি করো নাই মাইনে?!” একটু তেঁতে উঠলো আতর। “ঐ হোটেলটা কি বেটি তুমারে লেইখ্যা দিয়া গেছে, অ্যাঁ?”
হিটলু ঢোঁক গিললো আবার। “না…তা দিবো ক্যান।”
“তাইলে তার হোটেলের নাম তুমি নিলা কুন সাহসে?”
“আমি তো তার নাম নেই নাই। আমার হোটেলের নাম রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি। আর ওইটার নাম আছিলো”।
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো আতর। “রাখো তোমার দুই নম্বরি কথাবার্তা। এইসব বুজ আমারে দিবা না, সুন্দরপুরের আবলা-ভ্যাবলা মানুষজরে দিবা, তারা লুঙ্গির নীচ দিয়া পুটকি খাউজ্যাইতে খাউজ্যাইতে হ-হ কইরা তোমার কথা বিশ্বাস করবো।”