মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা।
“হিটলু কই, দেখতাছি না যে?” রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননির দিকে ইঙ্গিত করে বললো ইনফর্মার।
“হের খবর আমি রাখি না!” তিক্তমুখে জবাব দিলো ফজলু।
মুখোমুখি দুই রেস্টুরেন্টের মধ্যে প্রতিযোগীতাটি যে ব্যক্তিগত রেষারেষিতে গড়িয়েছে তা বুঝতে বাকি রইলো না ছফার।
“আমাগো এই ফজলুমিয়া একটু লেট কইরা ফালাইছিলো, স্যার, বুঝলেন?”
ছফা কিছু বললো না।
“বেটি ভাগনের পর বেকার হয়া ঘুইরা বেড়াইতো, তারপর গত বছর যখন দেখলো তার ইয়ারদোস্ত হিটলু কাম সাইরা ফালাইছে, তহন হের বুদ্ধি খুললো।” ফজলু কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আবার বলতে লাগলো সে, “হিটলু তো হিটলারি বুদ্ধি নিয়া চলে…বেটির হোটেলের নামটাই মাইরা দিছে।” বিচ্ছিরি হাসি দিলো ইনফর্মার। যেনো ফজলুর এই বোকামিতে সে ভীষণ মজা পেয়েছে। “হেয় আর কী করবো, চোর ভাগনের পর বুদ্ধি খুলছে। তয়, হে-ও কম যায় না, এক্কেবারে বেটিরেই মাইরা দিছে!” শেষ কথাটা মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে অদৃশ্য কোথাও প্রবলভাবে ঢুকিয়ে দেবার মতো বিচ্ছিরি একটা ইঙ্গিত করে বললো আতর।
ফজলু একটু কাচুমাচু খেলো। “আরে না, ভাই…আমি তো আমার মাইয়ার নামে এইটা রাখছি। আমার মাইয়ার নাম—”
“রাখো মিয়া!” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো ইনফর্মার। “মিছা কও ক্যান! তোমার মাইয়া যহন পয়দা হইলো, নাম তো রাখছিলা গুলনাহার, হে আবার মুশকান হইলো কবে থিকা?” ছফার দিকে তাকালো। “ওয় মনে করছে আমি এইসব বাইর করতে পারুম না। আরে, আমার নাম হইলো বিবিচি…সুন্দরপুরে কী হয় না-হয় সব আমি জানি!” গর্বিত ভঙ্গিতে বললো সে।
“আতরভাই, আপনে ভুল কন নাই। গুলনাহার তার আসল নাম, ডাক নাম কিন্তু মুশকানই রাখছি।”
“এইসব বুজ আমারে দিয়া কাম হইবো না, আমারে মদনা পাইছোনি!”
“আহ,” ইনফর্মারকে থামিয়ে দিলো ছফা। “বাদ দাও তো এসব কথা।” সে বুঝতে পারছে, ফজলুর চিকন বুদ্ধির কাজকারবার। মুশকান জুবেরির খাবারের সুনাম ছিলো, এটা অস্বীকার করবার জো নেই। মহিলার অনুপস্থিতিতে তার সুনাম ব্যবহার করার মতো কেউ থাকবে না তা কি হয়? এই দেশে এরকমটা আশা করা যায় না। এখানে সফলতাকে অনুসরণ নয়, অনুকরণ করার চেষ্টা করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে পুরোপুরি হাইজ্যাকও করে কেউ কেউ। রবীন্দ্রনাথের সাবেক দুই কর্মচারী সেটাই করেছে।
“স্যার, ফজলুর লগে কিন্তু আমাগো মাস্টরের হট টেরাম,” আঙটার মতো করে দুই তর্জনি আঁটকে দেখালো আতর।
ছফা অবাক হয়ে তাকালো লোকটার দিকে।
মুশকানের মালিক ব্যাখ্যা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। “আতরভাই ভুল বুঝছে, স্যার। উনার স্কুলে তো অনেক বাচ্চা…তিনবেলা খানা দিতে হয়, বিরাট আয়োজন করা লাগে। মাস্টারসাব আমারে এই কাজের দায়িত্ব দিসেন। আমি তারে হেল্প করি।”
ছফা কিছু বললো না।
“উনি হইলেন এই এলাকার মুরুব্বি, মাইন্যগণ্য মানুষ। এমপিসাবে যখন আমারে বললেন, আমি যেন মাস্টারসাবরে হেল্প করি তখন কি না কইরা পারি, কন?”
এবার আতরের দিকে তাকালো নুরে ছফা, “চলো, যাই।”
“কিছু না খাইয়া যাইবেন, তা কি হয়?” ফজলু বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেও ছফার কাছে মনে হলো লোকটা খাতির করে ভাব জমাতে চাচ্ছে। “গরীবের হোটেলে আসছেন, একটু খানাপিনা কইরা যান?”
“এখন না, মাত্র এলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে নেই তারপর আসবো।” কথাটা বলেই আতরকে নিয়ে চলে গেলো ছফা। ফজলু আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ করার সুযোগ পেলো না।
“আপনে উঠবেন কই? এসপির বাসায়?” হাঁটতে হাঁটতে আরেকটু সামনের দিকে যেতেই আতর আলী বলে উঠলো।
“না, টাউনের হোটেলেই উঠবো,” নুরে ছফা বললো।
“সুরুত আলীর হোটেলে?” ইনফর্মার বিস্মিত হলো। “ঐটা তো এহন পুরা খান” জিভে কামড় দিয়ে দিলো সে। আরেকটু হলে বেফাঁস কথাটা বলেই ফেলতো। “যাউক গিয়া, আপনে যে-কয়দিন আছেন হোটেলটা ঠিকঠাকমতোই চলবো, চিন্তার কিছু নাই।”
সুন্দরপুরের আগের এসপি বদলি হয়ে গেছে বহু আগেই। নতুন এসপির বাংলোতে ওঠার কথা ভেবেছিলো ছফা কিন্তু ভদ্রলোক সপরিবারে থাকেন, তাই ওখানে ওঠার কোনো ইচ্ছে নেই তার।
“দুইটার খাওন-দাওনই ভালা,” বললো আতর। “আমি মাজেমইদ্যে খাই। তয়, হিটলুর চায়া ফজলুর হাত বেশি ভালা।”
ছফা কিছু বললো না। তার ধারনা, এই নতুন হোটেলে নিয়মিত খায়দায় ইনফর্মার, আর সেটা অবশ্যই বিনে-পয়সায়। তবে এখানে খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই তার। নাম দুটো তাকে একটি ব্যর্থতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এটা এক ধরণের পুরনো ক্ষত, যেটার উপশম এখনও হয়নি।
যে মাটিতে আছাড় খাইছেন সেই মাটি থেইকাই আপনেরে উঠতে হইবো-কেএস খানের কথাটা যেনো মাথার ভেতরে উচ্চারিত হলো আরেকবার। মনের অজান্তেই হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গেলো তার।
এখানেই আমি ব্যর্থ হয়েছি, এখান থেকেই আমাকে আবার শুরু করতে হবে…নতুন করে, মনে মনে বলে উঠলো নুরে ছফা।
.
অধ্যায় ১৮
সুন্দরপুরে রাত নেমে এসেছে। নিরিবিলি হয়ে গেছে এর মহাসড়ক। থানা থেকে বেশ কিছুটা দূরে পরিত্যক্ত একটি বসত বাড়ির উঠোনের সিঁড়িতে বসে আছে আতর আলী। এককালে এখানকার সম্ভ্রান্ত ভট্টাচার্য পরিবারের বাস ছিলো। একাত্তরে তাদের যে কয়জন বেঁচে ছিলো, সবাই চলে গেছিলো কলকাতায়। কেউ আর ফিরে আসেনি। এরপর থেকে নানাজনের হাত ঘুরেছে এটা। কখনও কোনো সারের ডিলারের গোডাউন, তো কখনও আগের এমপির পোলাপানদের আখড়া। এখন অবশ্য পরিত্যক্ত হয়েই পড়ে আছে। তবে শোনা যাচ্ছে, এই বাড়িটা সুন্দরপুরের ফেকু সরকারের অরিন্দম নাট্যসংঘের কাছে দিয়ে দেবে বর্তমান এমপি।