.
অধ্যায় ১৭
রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি।
তিক্ততার সাথেই সাইনবোর্ডের লেখাটা পড়লো নুরে ছফা। বেশ বড় করেই লেখা হয়েছে নামটা, সাইনের ফন্ট অবিকল আগেরটার মতোই, তবে সেটার নীচে ছোট্ট করে লেখা : রেস্টুরেন্ট।
রবীন্দ্রনাথের উল্টোদিকে তাকালো সে।
মুশকান রেস্টুরেন্ট!
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। সুন্দরপুর টাউনে, সুরুত আলীর নোংরা হোটেল থেকে কয়েকশ’ গজ দূরে, রাস্তার দু-পাশে এই দুটো রেস্টুরেন্ট ঝড়বাদলা শেষে, ভর সন্ধ্যায়ও কাস্টমারের ভীড়ে গমগম করছে। দেখলেই বোঝা যায় বেশ নতুন। আকার এবং আকৃতিও প্রায় সমান। যেনো অলিখিত একটি প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়েছে তারা।
আতর আলী তাকে বলেছে, এ দুটো রেস্টুরেন্ট দিয়েছে মুশকান জুবেরির সাবেক দুই কর্মচারী হিটলু আর ফজলু-অন্য সব কর্মচারীর মতো রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি বন্ধ হবার পর বেকার হয়ে পড়েছিলো তারা। একজন আগের রেস্টুরেন্টের নামটা প্রায় হুবহু বগলদাবা করলেও অন্যজন খোদ মুশকান জুবেরিকেই আত্মসাৎ করে ফেলেছে। চতুর ঐ কর্মচারী আগের নাম থেকে ‘খেতে’ শব্দটা বাদ দিয়েছে সম্ভবত আইনী ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য। যদিও ছফা নিশ্চিত, মুশকান কখনও রেস্টুরেন্টের নামটা দাবি করে আইনী পদক্ষেপ নেবে না, ফিরে আসবে না সুন্দরপুরে।
তিন বছর আগে, সুন্দরপুর ছেড়ে চলে যাবার পর রবীন্দ্রনাথের কর্মচারীরা রাতারাতি বেকার হয়ে পড়েছিলো। চাকরিহারা মানুষগুলোর সবাই নতুন কাজ জুটিয়ে নিতে পারেনি, বেশির ভাগই বেকার হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে কিছু দিন। এই অঞ্চলে এমন রেস্টুরেন্ট নেই যেখানে কাজ করে তারা আগের মতো বেতন-ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা পাবে। তো তাদের মধ্যে প্রথমে হিটলু নামের এক কর্মচারী এগিয়ে আসে, সাহস করে দিয়ে বসে নতুন একটি রেস্টুরেন্ট-প্রায় হুবহু আগের নামটার মতোই।
দ্বিতীয়জনের বুদ্ধি খুলেছে একটু দেরিতে। সে রেস্টুরেন্টের নামটা করায়ত্ত করতে না পারলেও স্বয়ং এর মালেকিনকেই নিয়ে নিয়েছে!
কর্মচারী দুজন যেমন চালাক, তেমনি সৃজনশীলও বটে!
বাইরে থেকেও দেখা যাচ্ছে, অল্প খরচেই ছিমছাম সাজগোজ করা হয়েছে রেস্টুরেন্ট দুটোর। সাধারণত অন্য রেস্টুরেন্টগুলোতে সামনের দিকটায় চুলা রাখা হয় গরম গরম পরোটা, লুচি, পুরি, ডিম ভাজার জন্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি আর মুশকান একটু ব্যতিক্রম, আগেরটার মতোই।
সামনের এক চিলতে যে খালি জায়গাটুকু আছে, সেখানে ফুলের টব বসানো হয়েছে। বাঁশের বেড়া দিয়ে জায়গাটার দু-পাশ ঘেরা। সেই বেড়াতে আবার সাদা-লাল রঙে রঙ করা। রেস্টুরেন্ট দুটো জমজ ভাই বোনের মতোই দেখতে, শুধু ললাটের তিলক দুটো আলাদা-আর সেটাই তাদেরকে বিভক্ত করে রেখেছে!
“দ্যাখছেন?” আতর আলী বলে উঠলো পাশ থেকে। “দুইটাতেই কাস্টমারে গিজ গিজ করতাছে।”
“কিন্তু ওদের খাবার কি আগের রেস্টুরেন্টটার মতো হয়?”
আতর দাঁত বের করে হাসলো। “হয় তো…নাইলে কি অ্যাতো। মাইনষে খাইতে আহে?”
অবাক হলো ছফা। তার ধারণা ছিলো, মুশকান জুবেরির সমস্ত রেসিপিই সিক্রেট, কেউ সেটা নকল করতে পারে না।
“তুমি না বলেছিলে, এর আগে ওই রেস্টুরেন্টের কিছু কর্মচারী চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেরা রেস্টুরেন্ট করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে ওরকম স্বাদের খাবার তৈরি করতে?”।
আবারো দাঁত বের করে হাসলো ইনফর্মার। “ঠিকই কইছিলাম, স্যার…তয় হিটলু আর ফজলুর কপাল ভালা। বেটি যে রাইতে পলাইলো, তার আগে ওগোর কাছে মেডিচিনগুলা দিয়া গেছিলো…ওইগুলান দিয়াই তো খাওনের স্বোয়াদ বাড়ায়।”
বুঝতে পারলো ছফা। মুশকান জুবেরির রেসিপিগুলো সিক্রেট ছিলো, তবে রান্না করার পর প্রতিটি খাবারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সিরাপ মেশাতো, আর সেটাই খাবারের স্বাদকে অসাধারণ পর্যায়ে নিয়ে যেতো। এই সিরাপগুলো কী দিয়ে তৈরি সেটা ঐ মহিলা ছাড়া আর কেউ জানতো না।
“ওই দুই বাটপার বহুত মাথা খাটায়া মেডিচিনগুলার নকল বানাইছে। মেডিচিনগুলা নিয়াই দুই হালারপুতের মইদ্যে যতো ক্যাচাল।”
নুরে ছফা কিছু বলতে যাবে অমনি একটা কণ্ঠ শুনে চমকে তাকালো তারা।
“আরে, আতরভাই যে!”
ছফা আর ইনফর্মার দেখতে পেলো মাঝবয়সী হালকা-পাতলা গড়নের এক লোক এগিয়ে আসছে তাদের দিকে, মুখে এঁটে রেখেছে কৃত্রিম হাসি। কিন্তু হাসির আড়ালে যে আশঙ্কা জেঁকে বসেছে সেটা পুরোপুরি লুকাতে পারেনি।
“স্লামালেকুম।”
“ফজলুমিয়া নাকি,” আতর মুখ বেঁকিয়ে বললো। “ব্যবসা তো জমজমাট তোমার।”
ফজলু নামের লোকটি অমায়িক হাসি দিলো। “সব আপনাগোর দোয়া।”
“ধুর মিয়া, কী কও!” বাঁকাহাসি দিলো আতর। “আমাগো দোয়া হইবো ক্যান, সব তোমার চিকনা বুদ্ধির খেইল। ভালাই খেল দেখাইছে তোমরা…বেটির নাম ভাঙ্গাইয়া পকেট ভরতাছো!”
বিব্রত বোধ করলো ফজলু। “কী যে কন, আতরভাই।”
চোখমুখ নাচিয়ে নুরে ছফার দিকে তাকালো ইনফর্মার। “ইনি আমাগো ছফাস্যার…বিরাট বড় ডিবি অপিসার…ঢাকা থিকা আসছেন…তগো বেটি যার ডরে হোগার কাপড় মাথায় তুইল্যা পলাইছিলো!”
রবীন্দ্রনাথের সাবেক কর্মচারি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো একটু। সম্ভ্রমের সাথে বলে উঠলো, “স্লামালাইকুম, স্যার…ভালো আছেন?”