নুরে ছফা।
একটু আগে তাকে লাইব্রেরির সামনে দেখামাত্র এক ধরণের আশঙ্কা জেঁকে বসেছে তার মধ্যে। মনে হচ্ছে, অশুভ কিছু ঘটবে আবার। বিগত তিন বছর ধরে এই লোকের কোনো টিকিটাও দেখা যায়নি সুন্দরপুরে। তাহলে কী কারণে আবার এসেছে এখানে?
ভাবনাটা মাস্টারের মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। তিনি এমন কিছু করেননি, এমন কিছুতে জড়িত নন যে, একজন পুলিশ কর্মকতার আগমনে বিচলিত হয়ে উঠবেন। এসবই নিছক আশঙ্কা। সম্ভবত, তিল তিল করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার পর তার মধ্যে সবকিছু হারানোর ভয় জেঁকে বসেছে। আগে তার কিছুই ছিলো না, হারানোরও কোনো ভয় ছিলো না তখন।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। এই এক জীবনে কম তো দেখলেন না। উত্থান আর পতনের খেলাটা যেনো তার কাছে ঋতুচক্রের মতোই-ঘুরে ফিরে আসে বার বার।
ঘরের জানালাটা খুলে দিয়ে বাইরে তাকালেন। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার ভাবনায় খেলা করে যাচ্ছে অনেক কিছু। স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেন তিনি।
এক সময় তার অনেক কিছুই ছিলো, তারপর সবকিছু কেড়ে নিলো পাক হানাদারেরা। আবারো তিনি কিছু ফিরে পেলেন স্কুলের ছোটোছোটো বাচ্চাগুলোকে আলোকিত করার কাজ পেয়ে। সেগুলোও এক সময় হাতছাড়া হয়ে গেলো। সারাজীবনের যে ব্রত ছিলো শিক্ষকতা করার, সেখান থেকেও বিতাড়িত করা হলো তাকে। অবশেষে জীবনের শেষ সময়ে এসে, অনেকটা আচমকাই, জাদুমন্ত্রের মতো সবকিছু পাল্টে গেলো চোখের নিমেষে। তিনি পেয়ে গেলেন তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের সোনার চাবিকাঠি! আর সেটা এমন একজনের কাছ থেকে, যার ব্যাপারে তার মনে ছিলো যথেষ্ট সন্দেহ, সংশয়। শঠ আর ধান্দাবাজ মানুষজন তিনি সারাটা জীবন এড়িয়ে চলেছেন, কিন্তু তার স্বপ্ন এতোটাই বড় ছিলো যে, তিনি আর এসব পরোয়া করেননি। নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিয়েছেন, যা করছেন বৃহত্তর স্বার্থেই করছেন। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কিছু করছেন না।
তাছাড়া মুশকান জুবেরি যা করেছে সেটা জমিগুলোর আসল মালিকের ইচ্ছের বাস্তবায়ন ছাড়া আর কিছু না। জমিদার বাড়ির সম্পত্তিগুলো কখনও তার ছিলো না, যখন বুঝতে পেরেছে ভবিষ্যতেও থাকবে না, তখন সেগুলো যাকে দেবার তাকে দিয়ে চলে গেছে। রাশেদ জুবেরি মৃত্যুর আগেই বলে গেছিলো, তার নামে থাকা বিশাল সম্পত্তির প্রায় সবটাই যেনো ট্রাস্টে দিয়ে দেয়া হয়। ঐ মহিলা চাইলে তার রেস্টুরেন্টের জায়গাটাসহ আরো কিছু জমি রেখে দিতে পারতো কিন্তু সুন্দরপুরে যখন আর থাকা সম্ভব নয় তখন ঐ সম্পত্তিগুলোও স্কুলের ট্রাস্টে দিয়ে দিয়েছে সে।
রাশেদ জুবেরির কথা মনে পড়ে গেলো। বেশ সখ্যতা ছিলো মাস্টারের সাথে। তিনি ভালো করেই জানেন, মায়ের বাপের কাছ থেকে পাওয়া সুন্দরপুরের জমিজমাগুলো নিয়ে রাশেদের মধ্যে কোনো আগ্রহ ছিলো না কোনো কালে। মনেপ্রাণে চাইতো জমিগুলো যেনো ভালো কাজে ব্যবহার করা হয়-মাস্টারের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় বেশ কয়েক বার রাশেদ তাকে বলেছিলো, এখানকার জয়াগাজমিগুলোর প্রতি তার কোনো আগ্রহ না থাকলেও তার ঠাকুরদার বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধার করার চেষ্টা করবে। সে চায় না, ওগুলো খারাপ লোকের খপ্পরে পড়ে থাকুক। বিশেষ করে যে লোক তার মা-সহ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করিয়েছে তারই কুপুত্র ওগুলো ভোগদখল করবে এটা কোনোভাবেই হতে দেবে না সে। জমিগুলো উদ্ধার করে ভালো কাজের জন্য দান করে দেবে। কী কাজে দান করা হবে সেটা জানতে ইচ্ছে করলেও মাস্টার জিজ্ঞেস করেননি কখনও। তবে রাশেদ নিজে থেকেই বলেছিলো, সময় হলে নাকি মাস্টারই সবার আগে সেটা জানতে পারবেন।
মুশকান জুবেরি যে উদ্দেশ্যেই এখানে এসে থাকুক, যা-ই করে থাকুক, তার সাথে রমাকান্তকামারের কিংবা অলোকনাথ বসুর সম্পত্তিগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। ওগুলোর নিয়তিই হয়তো এমন ছিলো। কতোগুলো কালোহাত ঘুরে শেষমেষ ভালো কাজের জন্যই ব্যবহৃত হবে।
মহিলা সুন্দরপুর না এলে অবশ্য এতো কিছু ঘটতো কিনা সন্দেহ আছে। জমিগুলো হয়তো ঐ কোলাবরেটরের ছেলে আসাদুল্লাহর করায়ত্তেই থাকতো। আবার এ-ও ঠিক, নুরে ছফা নামের লোকটা না এলেও মুশকান জুবেরি সুন্দরপুর থেকে সহসা পালাতো না, জমিগুলোও মাস্টারের কাছে দিয়ে যেতো কিনা সন্দেহ আছে। সেদিক থেকে দেখলে ছফার কাছেও মাস্টার কিছুটা ঋণী। কিন্তু লোকটার চাতুর্য তার কাছে ভালো লাগেনি শুরু থেকেই। সুন্দরপুরে এমনও গুজব আছে, ঐ লোক আসলে আসাদুল্লাহর হয়েই কাজ করেছে। ঢাকা থেকে উড়ে এসে মহিলাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছিলো, শেষে উপায় না দেখে জমিদার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টাও করে। কিন্তু মহিলা প্রাণ নিয়ে সুন্দরপুর ছেড়ে চলে যায়।
অবশ্য অন্য রকম গুজবও আছে, মুশকান জুবেরি নাকি বিরাট বড় এক অপরাধী। কী অপরাধ করেছে সে-ব্যাপারে সুন্দরপুরের কারোর কোনো ধারনা নেই। তারা এমপির চক্রান্তের গল্পটাকেই বেশি যুক্তিযুক্ত বলে বিশ্বাস করে এখন।
আজ প্রায় তিন বছর পরে আবারো সেই লোক এসে হাজির হয়েছে। সুন্দরপুরে। আবারো অশুভ কিছু ঘটবে বলেই আশঙ্কা করছেন মাস্টার। তবে যা-ই ঘটুক না কেন, তাকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ঘটনাই যেনো তার স্বপ্নের স্কুল আর লাইব্রেরিটাকে ছুঁতে না পারে।