মোটা কাঁচের চশমার ভেতর দিয়েও বোঝা যাচ্ছে, ছফাকে দেখতে পেয়ে রমাকান্তকামারের চোখদুটোতে নেমে এসেছে বিস্ময়।
“আদাব, মাস্টারসাহেব…ভালো আছেন?” বললো ছফা।
আনমনেই মাথা নেড়ে সায় দিলেন ভদ্রলোক। “আপনি?…এখানে?!” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন তিনি।
.
অধ্যায় ১৫
নুরে ছফা চায়নি সুন্দরপুরে পা রাখতেই মাস্টার রমাকান্তকামারের সাথে দেখা হয়ে যাক। সে জানতো না লাইব্রেরিতে এ সময় মাস্টার থাকবেন। ভদ্রলোকের মুখোমুখি হবার চেয়েও বেশি অস্বস্তিকর ছিলো তার করা প্রশ্নটি।
আপনি…এখানে?
ছফা এর জবাবে কী বলবে ভেবে পায়নি। কয়েক মুহূর্ত লেগে গেছিলো জবাব দিতে। “এইতো…একটা কাজে আসতে হলো আবার।” একটু সময় নিলেও বলতে পেরেছিলো সে। “বৃষ্টির কারণে এখানে আটকা পড়ে গেছি।”
রমাকান্তকামার অবশ্য বেশি কিছু জানতে চাননি, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ ছাতা ফুটিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই বের হয়ে যান।
“বিকালবেলা মাস্টর এইহানেই থাকে,” রমাকান্তকামার চলে যাবার পর বললো আতর আলী। “দুনিয়ার যতো বই আছে কিইন্যা ভইরা ফালাইতাছে, পোলাপানের মাথা খায়া ফালাইছে এক্কেবারে।”
ছফা এ কথার জবাবে কিছু বললো না। আতর আলীর মতো লোকের কাছে কেন, অনেক দ্র আর সজ্জন মানুষও বই পড়াকে ফালতু কাজ হিসেবে দেখে এ দেশে। তার ছোটোবেলার একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার আগে গল্পের বই পড়তে গিয়ে বাবার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়, তারপর সে কী বকুনি! যেনো বিশাল এক গর্হিত কাজ করে বসেছে।
আতর আরো বক বক করে গেলো। সুন্দরপুরে বিগত তিন বছরে কী কী ঘটেছে তার সবটাই যেনো এক লহমায় উগলে দিতে চাইছে সে। বাইরের বৃষ্টি দেখে দেখে কিছুটা আনমনা হয়ে ছফা তার কথা শুনে গেলো।
এমপির মৃত্যু সুন্দরপুরের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। তিন মাস পর উপনির্বাচনে নতুন যে এমপি নির্বাচিত হয়েছে, মানুষ হিসেবে সে বেশ সজ্জন। নতুন এমপি বয়সে তরুণই বলা চলে। রমাকান্তকামারের সাবেক ছাত্র সে। স্নেহধন্য ছাত্র এমপি হবার পর তার সাহায্যে খুব দ্রুতই জমিদার বাড়িতে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘সুন্দরপুর শান্তিনিকেতন উচ্চবিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল। এ অঞ্চলের সবচাইতে বড় আর অন্য রকম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ-গান-ছবি আঁকাসহ অনেক কিছুই শেখানো হয়।
“আগের এমপির যেইসব জায়গা-জমি দখলে রাখছিলো সেইগুলা নয়া এমপি দখল কইরা স্কুরে দিয়া দিছে, আর বলতে লাগলো। “বেটা তো মরছেই, হের জায়গা-জমিও সব গেছে। ঐ যে, পেট্রল পাম্পটা আছে না…ঐটাও বন্ধ কইরা দিছে এমপিসাবে। হুনতাছি, ওইটা নিজেই লিজ নিবো।”
“আগের এমপির ছেলেমেয়েরা বাধা দেয়নি, মামলা-মোকদ্দমা করেনি?”
“হেরা তো বিদেশে থাকে, এইসব নিয়া হাউকাউ ক্যামনে করবো। কইরা কোনো লাভ হইবো? কাগজপত্রে ঘাপলা আছে না?”
“আচ্ছা, ফালুর কোনো খবর জানো? সে আর সুন্দরপুরে আসেনি?”
আতরের মুখ তিক্ততায় ভরে উঠলো। “চুতমারানির পোলায়…” গালিটা দিতেই সামলে নিলো সে। “আইছিলো তো রাইতের বেলায়… বইনের লগে দেহা করতে! চোরের মতো আইছে আবার চোরের মতোই। কাইট্টা পড়ছে। আমি যদি ওরে পাইতাম মাটিতে পুইত্যা ফালাইতাম!” শেষ কথাটা দাঁতে দাঁত পিষে বললো ইনফর্মার। ফালু যে তাকে জিন্দা কবর দেবার ব্যবস্থা করেছিলো সেটা এখনও ভোলেনি।
“ঐ রাতকানা মেয়েটা এখনও আছে?” একটু অবাক হলো ছফা।
“হ। ঐ মাইয়া এহন মাস্টরের স্কুলে কাম করে। স্কুলটা ম্যালা বড়…কতোজন যে কাম করে জানেন না।”
“ফালু যে এখানে এসেছিলো সে-কথা তুমি জানলে কিভাবে?”
দাঁত বের করে হেসে ফেললো আতর। “মাস্টরের স্কুলে আমার এক লোক আছে, স্যার,” খুবই গর্বিত ভঙ্গিতে জানালো কথাটা। “হে আমারে কইছে।”
গোরখোদক ফালুকে নিয়ে অবশ্য ছফার কোনো আগ্রহ নেই, যেমনটা আগ্রহ আছে তার সিনিয়র কেএস খানের মধ্যে।
“আচ্ছা, এখানে আসার পর দেখলাম রহমান মিয়া আগের জায়গাতেই আছে,” প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললো সে। “তার ব্যবসা কেমন চলে। এখন? রেস্টুরেন্টটা তো নেই, মানুষজন আসে এখানে?”
“পাম্পটাও তো বন্ধ,” আতর বললো। “এই রোডে এহন আর গাড়িঘোড়া থামে না…হের ব্যবসা উঠছে চাঙ্গে। তয় অন্য কিছু তো করবার পারে না, পারে খালি গুড়ের চা বানাইতে আর গপসপ করতে। হেরে কইছিলাম, নতুন হোটেল দুইটার সামনে গিয়া নাড় গাঁড়ো, এইখানে তো কেউ মুততেও আহে না সারাদিনে। কিন্তু হে তো আইলসা, বইস্যা বইস্যা
“নতুন দুটো হোটেল হয়েছে মানে?” ইনফর্মারের কথায় বাধা দিয়ে জানতে চাইলো ছফা।
জিভে কামড় দিলো আতর আলী, যেনো মূল্যবান একটি তথ্য জানাতে ভুলে গেছিলো। “আপনেরে তো কই নাই, বেটির হোটেলের দুই পোলায় বিরাট বড় আকাম করা ফালাইছে। গত বছর হিটলু হারামজাদা বেটির হোটেলটা আবার দিছে, তারে দেইখ্যা ফজলুও আরেকটা দিছে। হালারপুতেগো মাথায় চিকনা বুদ্ধি গিজগিজ করে!”
.
অধ্যায় ১৬
নিজের বাড়ির বারান্দায় ভেজা ছাতাটা মেলে রাখলেন রমাকান্তকামার। বৃষ্টির প্রকোপ এখন কমে এসেছে, আর কিছুক্ষণ পরই থেমে যাবে। এরইমধ্যে নেমে গেছে সন্ধ্যা। তবে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে রাত বলেই মনে হচ্ছে।
পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার তালাটা খুলে ঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি। বিদ্যুৎ চলে গেছে, ঘরে ঢুকে পুরনো হারিকেনটা জ্বালিয়ে দিলেন। অন্ধকার তার কাছে সব সময়ই অপ্রিয়। তিনি পছন্দ করেন আলো, সেই আলোয় অন্যকে আলোকিত করতে। সারাটা জীবনই চলে গেছে এ কাজ করে করে। এখন জীবন সায়াহ্নে এসে হাতে একটি আলোকবর্তিকা পেয়ে গেছেন, সেটা দিয়ে যতোটুকু সম্ভব অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মনেপ্রাণে চাইছেন, তার অনুপস্থিতিতেও যেনো এই কর্মযজ্ঞ থেমে না যায়। কয়েক বছর ধরে দিনরাত পরিশ্রম করে অবশেষে নিজের স্বপ্ন বাস্তাবায়ন করতে পেরেছেন। কিন্তু সবকিছু যখন গুছিয়ে নিয়ে এসেছেন, তখনই সুন্দরপুরে এসে হাজির হয়েছে ঐ লোকটি।