একটু আগে রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে ছফা খুবই অবাক হয়েছিলো, রেস্টুরেন্টের সুদীর্ঘ নামটি একটিমাত্র শব্দে রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে এখনও টিকে আছে বলে।
সুন্দরপুরে এতো কিছু ঘটে যাবার পর কী করে নামটা টিকে আছে।
যেহেতু এটা আর এখন রেস্টুরেন্ট হিসেবে নেই, তাই শুধু ‘খেতে’ নয়, ‘এখানে কখনও আসেননি’ও বাদ দেয়া হয়েছে-যদিও সুন্দরপুরের জন্য এটাই সত্যি।
পুরনো ‘রবীন্দ্রনাথ’ সাইনটার নীচে ছোট্ট করে যুক্ত করা হয়েছে ‘স্মৃতি গ্রন্থাগার’ লেখাটি।
রবীন্দ্রনাথ স্মৃতি গ্রন্থাগার!
সুন্দরপুরের মতো কোনো অঞ্চলে এরকম একটি লাইব্রেরি আছে দেখে খুশিই হলো ছফা। কাজটা যে মাস্টার রমাকান্তকামারের সেটা বুঝতে বাকি। রইলো না। মুশকান জুবেরি যতো বড় ক্রিমিনালই হোক না কেন, জায়গা জমি যোগ্য একজনের হাতেই দিয়ে গেছে।
ছফা দেখতে পেলো ঘরের এককোণে বিশাল আকারে একটি গ্লোবও রাখা আছে। ঘরে বই ছাড়াও আছে বেশ কিছু মনীষীর ছবি। তার মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে বড় আর প্রধান ছবিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে চোখ গেলো এবার। ওটাও একটা ছবির ফ্রেম তবে তাতে কোনো ছবি নেই। বিশাল একটি বাদামি কাগজে কিছু লেখা। ছফা যেখানে আছে সেখান থেকে লেখাটা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। এই প্রথম সে টের পেলো চল্লিশের আগেই চালশে অবস্থা তার। ছোটো ছোটো অক্ষরগুলো পড়তে বেগ পাচ্ছে। আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে চোখ কুঁচকে তাকালো। লেখাটা যেই না পড়তে যাবে অমনি একটা কণ্ঠ পেছন থেকে বলে উঠলো :
“স্যার! কখন আইলেন?”
কথাটা এতো জোরে উচ্চারণ করা হলো যে, নুরে ছফাসহ লাইব্রেরিতে থাকা চার-পাঁচজন পাঠকের প্রায় সবাই চমকে ঘুরে তাকালো।
“আমি তো আপনেরে ফোন দিসিলাম কিন্তু ফোন-”
“আস্তে!” মৃদু ধমকের সুরে আতর আলীকে চুপ করিয়ে দিলো ছফা। ভ্যাবাচ্যাকা খেলো ইনফর্মার। তাকে নিয়ে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে গেলো ছফা।
“কী হইছে, স্যার?” আতর বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলো বাইরে এসে। তাকে কেন আস্তে কথা বলতে বলছে বুঝতে পারলো না।
“আরে, দেখছো না…এটা একটা লাইব্রেরি,” বললো ছফা।
“তো কী হইছে!” আতর এখনও বুঝতে পারছে না।
এই লোককে লাইব্রেরি কালচার নিয়ে জ্ঞান দেবার কোনো ইচ্ছে নেই ছফার।
“কিছু না,” বলেই রবীন্দ্রনাথের সামনের খোলা প্রাঙ্গনে কাছে এসে দাঁড়ালো সে। প্রবল বাতাসের সাথে ধুলো উড়ছে এখন। বৃষ্টি আসি আসি করছে। অনেক দিন পর দেখা হলো…এখন বলল, কেমন আছো?”
দাঁত বের করে হেসে ফেললো আতর আলী। “আমি ভালাই আছি, স্যার, আপনের ফোন বন্ধ পাইয়া আমি তো অস্থির হয়া গেছিলাম।”
“আসার পথে আমার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছিলো, তাই তোমাকে কল দিতে পারিনি।” এর আগে ইনফর্মারের সাথে তার কথা হয়েছিলো, সুন্দরপুর ঢুকেই তাকে কল দেবে।
বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই তারা দু-জন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রবেশদ্বারের সামনে শেডের নীচে এসে দাঁড়ালো।
“আপনে কিমুন আছেন, স্যার?” জিজ্ঞেস করলো ইনফর্মার। “এইদিকে তো আর আসেনই না।”
“ঢাকায় কাজের অনেক চাপ, ছফা বললো। “অনেকগুলো কেস তদন্ত করছি, দম ফেলার সময় পাই না।”
“আপনেরে দেইখ্যা কী যে ভালা লাগতাছে!” আন্তরিক ভঙ্গিতেই বললো আতর।
মুচকি হাসলো ছফা। সুন্দুরপুরের ইনফর্মারের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগের চেয়ে তার জামা-কাপড় একটু গোছালো আর দামি। মাথার চুলগুলোও পরিপাটি। নিয়মিত গোসল করে বলেও মনে হচ্ছে।
“তা, বলো…এখানকার খবর কী?” এমনি জানতে চাইলো।
“খবর তো ভালাই,” বললো আতর, “কতো কিছু যে হয়া গেছে, কী আর কমু আপনেরে।”
সুন্দরপুর থেকে চলে যাবার পর আতরের সাথে কয়েক মাস যোগাযোগ ছিলো ছফার। মাস্টারের পেছনে লেলিয়ে দেবার পরও যখন দেখা গেলো উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া যাচ্ছে না তখন ধীরে ধীরে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে সে, আতরের সাথেও যোগাযোগ কমে যেতে শুরু করে। এরপরও ইনফর্মার তাকে মাঝেসাঝে ফোন দিয়ে জানাতো মাস্টারের স্কুল নিয়ে ব্যস্ততার কথা, সেসবের প্রতি কোনো আগ্রহ তার ছিলো না। এক পর্যায়ে আতরের ফোন ধরাও বন্ধ করে দেয়-সময়ে অসময়ে ফোন দিতো সে নানান ধরণের তদবির নিয়ে। উপরন্তু দু-বছর আগে পুরনো ফোন নাম্বারটা পাল্টে ফেলায় আতরের পক্ষে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি দীর্ঘদিন।
“রহমান মিয়ার টঙ দোকানটা দেখলাম আগের মতোই আছে।”
ছফার মুখ থেকে রহমান মিয়ার নামটা শুনে ভেতরে ভেতরে মর্মাহত হলো আতর। প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার জন্য সে বললো, “মাস্টরের কিন্তু এখন বিরাট অবস্থা। এই যে দেখতাছেন…” রবীন্দ্রনাথের দিকে ইঙ্গিত করলো, “…এইটা তো মাস্টরেরই কাম। বিরাট বড় একটা স্কুলও দিছে, কতো কী যে…”
আতরকে এভাবে কথার মাঝখানে থেমে যেতে দেখে অবাক হলো নুরে ছফা। ইনফর্মারের দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকালো। সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, চোখে মোটা কাঁচের চশমা আর গালে শুভ্র লম্বা দাড়ি-গোঁফ-সৌম্যকান্তির অবয়বটি দেখেই চিনতে পারলো সে।
মাস্টার রমাকান্তকামার বগলে চামড়ার ব্যাগ আর হাতে একটি কালো রঙের ছাতা নিয়ে বের হয়ে আসছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে।
ছফা বুঝতে পারলো, লাইব্রেরির ভেতরে যে ছোট্ট একটি অফিস ঘর আছে, এতোক্ষণ নিশ্চয় সেখানে ছিলেন।