“তা, কী কাম তুমার এই ঝড়-তুফানের দিনে?” সিগারেটটা আতরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো দোকানি। “আজকাইল তো এইহানে বেশি আহো না…টাউনেই নাড় গাঁড়ছে।”
সিগারেটটা লাইটার দিয়ে ধরালো আতর, দীর্ঘ একটা টান দিয়ে রহস্যময় হাসি দিলো। “এতো কিছু তোমার জানোনের দরকার নাই, তুমি চা বানাও।”
বাঁকাহাসি দিলো রহমান। দ্রুত এক কাপ গুঁড়ের চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। কমদামি বিড়ি সিগারেট আর গুল খাওয়া আতর আলী এখন বেনসন ছাড়া অন্য কিছু মুখেই তোলে না। বিগত তিন বছরে তাকে কেউ গুল খেতে দেখেছে কিনা সন্দেহ। সবটাই কপাল। শহর থেকে এক লোক এসে এই ইতরের ভাগ্যটাই বদলে দিয়েছে। এখন একটা বাইকও কিনেছে সে। সারাদিন ওটা নিয়েই ছুটে বেড়ায় সুন্দরপুরসহ আশেপাশের এলাকায়। এক শ’ সিসির ছোটোখাটো পুরনো সেই বাইকটা যখন ইনফর্মার চালায় তখন রহমানের কাছে মনে হয়, দুর্বল আর নিরীহ ছাগলের পিঠে বুড়ো একটা শেয়াল সওয়ার হয়েছে।
“তুমার ভটভটি কই?”
ভুরু কুঁচকে রহমানের দিকে তাকালো আতর। এই বদটা তার মোটরসাইকেলকে ভটভটি বলে ডাকে সব সময়। এটা যে ঈর্ষা থেকে করে তা ভালো করেই জানে। রাগ দমন করে বললো, “মিস্তিরির কাছে দিছি…এটু টেরাবল দিতাছিলো।”
রহমান মিয়া দাঁত বের করে হাসলো। “পুরানা জিনিস কিনলে তো টেরাবল দিবোই।”
কিছু বলতে গিয়েও বললো না আতর। মানুষের এমন ঈর্ষা উপভোগ করে সে। কিন্তু এ মুহূর্তে সেটা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছে না নিজের ভেতরে থাকা অস্থিরতার কারণে।
রহমান আড়চোখে দেখতে পেলো ইনফর্মার বার বার সড়কের দিকে তাকাচ্ছে। পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করেও একবার দেখে নিয়েছে এরমধ্যে।
“ক্যাঠায় আইবো?” চামচ দিয়ে চায়ের সাথে গুড় মেশাতে মেশাতে জানতে চাইলো দোকানি। “কার লাইগ্যা এতো পেরেশান হয়া আছো?”
সিগারেটে টান দিয়ে একটু ঝারি মেরেই বললো আতর, “এতো কথা কও ক্যান, অ্যাঁ? আদার বেপারী তুমি…খালি জাহাজের খবর নিতে চাও!”
মুখে সেই বাঁকাহাসি ধরে রেখেই চায়ের কাপটা আতরের দিকে বাড়িয়ে দিলো রহমান মিয়া। “আমি বেপারী অইতে যামু কুন দুঃখে! তয় আমি কইলাম আন্ধা না, সব কিছু দেখবার পারি।”
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলো আতর, “কী দেখছো তুমি?” তারপর পিরিচে চা ঢেলে সশব্দে আয়েশ করে চুমুক দিলো।
“এই অবেলায় এইহানে ক্যান আইছো আমি জানি, বিজ্ঞের মতো বললো রহমান।
আতর আলী পায়ের উপর পা তুলে একহাতে সিগারেট আর অন্য হাতে পিরিচ ধরে রেখেছে। চায়ের কাপটা রেখেছে তার পাশে বেঞ্চের উপরে। “কও কি, মিয়া!” কৃত্রিম বিস্ময়ের ভাব করলো সে। “তুমিও কি নিজেরে বিবিচি ভাবোনি?”
পিরিচটা রেখে পকেট থেকে আবারো ফোনটা বের করে দেখে নিলো, একটা নাম্বারে কল দিয়ে কানে ফোনটা ঠেকিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ, একটু পর চিন্তিত ভঙ্গিতে নামিয়ে রাখলো সেটা। রহমান মিয়াকে হাসতে দেখে অবাক হলো সে।
“ওই মিয়া…হাসসা ক্যান?” একটু রেগেই বললো।
“না…এমনেই,” দোকানি বললো হাসিমুখে।
“ঠিক কইরা কও তো, হাসতাছো ক্যান…মিজাজ খারাপ করবা না। কইলাম!” মৃদু হুমকি দিয়ে বললো ইনফর্মার।
“আমি হইলাম আদার বেপারী, জাহাজের খবর জানাই কেমতে!”
ভুরু কুঁচকে ফেললো আতর। “বুঝলাম না, কী কও তুমি?”
“যার লাইগ্যা পেরেশান হয়া আছে সে তো বেটির হুটেলে ঢুকছে এটু আগে, রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়ে বললো রহমান।
অবাক হয়ে রাস্তার ওপারে তাকালো আতর। “ঐটা কি এহন আর হোটেল আছেনি, অ্যাঁ?” তারপরই টনক নড়লো তার। “কার কথা কইতাছো তুমি? কে ঢুকছে ওইখানে?”
“কইলাম না, তুমি যার লাইগ্যা পেরেশান হয়া আছে।”
আতর আলী কয়েক মুহূর্ত ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো দাঁত বের করে হাসতে থাকা দোকানির দিকে, তারপর হুট করেই উঠে দাঁড়ালো। “ধুর মিয়া! খালি ফালতু পেচাল পাড়ো…আগে কইবা না!” কথাটা বলেই চলে যেতে উদ্যত হলো সে।
“আরে, আমার ট্যাকা?”
রহমান জোরে বলে উঠলো পেছন থেকে কিন্তু আতর সে-কথা কানেই তুললো না, হনহন করে ছুটে গেলো রবীন্দ্রনাথের দিকে। এক কাপ চা আর সিগারেট বিক্রি করবে বলে সে আসল কথাটা দেরি করে বলেছিলো, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। বাকির খাতায় যোগ হলো আরো কিছু টাকা।
“ইতরের বাচ্চা ইতর!” চোখমুখ বিকৃত করে বললো সে। “কয়লা, ধুইলেও যায় না ময়লা। খাইসলত এহনও আগের মতোই আছে।”
.
অধ্যায় ১৪
প্রায় তিন বছর আগে সুন্দরপুরে এসে যেখানে প্রথম প্রবেশ করেছিলো সেখানে পা রাখতেই বিস্মিত নুরে ছফা।
তখন তাকে প্রলুব্ধ করেছিলো মাদকতাপূর্ণ খাবারের গন্ধ আর সুতীব্র কৌতূহল। এখনও তার মনে কৌতূহল রয়েছে, তবে সুস্বাদু খাবারের কোনো গন্ধ পাচ্ছে না। যদিও পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী খাবারে পরিপূর্ণ আছে ঘরটা!
বই।
রবীন্দ্রনাথের ভেতরটা আর আগের মতো নেই। আগের মতো যে থাকবে সে আশাও করেনি, তবে চোখের সামনে যা দেখতে পাচ্ছে সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি! পাতা ওল্টানোর খসখসে শব্দটা শুনতে পেলো। হাতেগোনা কিছু পাঠক একমনে বই পড়ে যাচ্ছে। লাইব্রেরির চিরায়ত দৃশ্য।
নুরে ছফা দরজা খুলে ঢুকতেই সেই ঝড়ো বাতাসের কিছুটা ঢুকে পড়েছিলো ঘরের ভেতরে, বই পড়ুয়ারা মুখ তুলে তাকালেও আবারো ফিরে যায় শব্দের জগতে। এক সময়কার রেস্টুরেন্টের দেয়ালগুলো দখল করে আছে বইয়ের শেল্ফ, আর সেগুলোতে ঠাঁই করে নিয়েছে অসংখ্য বই। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তিন বছর আগের দৃশ্যটার সাথে এক ধরণের সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিলো সে-প্রথমবার দেখেছিলো চার-পাঁচজন ভোজনরসিক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে খাবারের আস্বাদন নিচ্ছে, আর এবার দেখেছে। অল্প বয়সী কিছু পাঠক ডুবে আছে বইয়ের পাতায়। চারপাশে বইয়ের শেঙ্কের মাঝে দুটো বিশাল রিডিং টেবিলে বসে আছে নিবিষ্ট পাঠকের ছোট্ট দলটি। মাথার উপরে ঘুরছে সিলিংফ্যান। সেগুলোর গুঞ্জন ছাড়া আর কিছুই নেই।