কয়েক বছর আগে এই লোক ঠিক এভাবেই এক বিকেলে এসে হাজির হয়েছিলো সুন্দরপুরে, তারপর এখানে ঘটে যায় কিছু ঘটনা-জমিদার অলোকনাথ বসুর পৈতৃক বাড়িটা আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়; গোরখোদক ফালু পালিয়ে যায় সুন্দরপুর থেকে; রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি নামের রেস্টুরেন্টটি রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায়; পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় এর মালেকিন; এরপরই সুন্দরপুরের এমপি ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে মৃত্যুবরণ করে।
রহমান মিয়ার মতো এলাকাবাসিও জানে না এসব ঘটনার পেছনে আসল কারণগুলো কী। তারা কেবল নিজেদের মতো করে ঘটনাগুলো বয়ান করে। তবে এসবের পেছনে প্রয়াত এমপির কালোহাত যে ছিলো সে ব্যাপারে কারোর মধ্যে সন্দেহ নেই।
জমিদারের নাতবৌ সেজে সুন্দরপুরে জেঁকে বসেছিলো মুশকান নামের ঐ মহিলা। তার রেস্টুরেন্টে মানুষের মাংস রান্না করে বিক্রি করা হতো। গোরখোদক ফালুকে দিয়ে কবরস্তান থেকে কঙ্কাল তুলে ব্যবসাও করাতো সে!-এ ধরণের কথা প্রথম দিকে সুন্দরপুরের অনেকে বিশ্বাস করলেও এখন খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যারা এসবে বিশ্বাস করে। বরং ইদানিং মানুষজন বলে বেড়ায়, সুন্দরপুরের আগের এমপি আসাদুল্লাহ ঐ মহিলাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিলো, যাতে করে জমিদার অলোকনাথের সমস্ত সম্পত্তি দখল করে নিতে পারে। এমন কি ঢাকা থেকে এক ভাড়াটে পুলিশ এনে লেলিয়ে দিয়েছিলো মহিলার পেছনে। শেষে, ঐ লোক জমিদার বাড়িতে আগুন দিয়ে মহিলাকে হত্যা করারও চেষ্টা করে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়ে সুন্দরপুর ছেড়ে পালিয়ে যায় জমিদারের নাতবৌ। তার আগে এমপির আশার গুড়ে বালি দিয়ে জমিদারের সমস্ত সম্পত্তি দান করে গেছে সুন্দরপুরে একটি স্কুল করার জন্য। ওদিকে হতাশ আর ব্যর্থ এমপি ঢাকায় বসে রাগে-ক্ষোভে, হতাশায় মদ্যপান করতে গিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলে, তার নাজুক হৃদপিণ্ড আর সহ্য করতে পারেনি, মদে ডুবেই সাঙ্গ হয়েছে তার ভবের লীলা।
রহমান দেখতে পাচ্ছে, এমপির ভাড়া করা সেই পুলিশ, যার পেছনে ইনফর্মার আতর লাট্টুর মতো ঘুরতো, সেই লোক এখন রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রবল বাতাসে লোকটার শার্ট-প্যান্ট লেপ্টে আছে শরীরের সাথে, চুলগুলো উড়ছে সেই বাতাসের ঝাপ্টায়।
রহমান মিয়ার কাছে এটা এক ধরণের অশনি সংকেত। তার অন্তরাত্মা বলে উঠলো, এই লোক সঙ্গে করে ঝড় নিয়ে এসেছে সুন্দরপুরে! খারাপ। কিছু হবার আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠলো তার মনে।
*
একটু আগেও রোদের উত্তাপ ছিলো, কোত্থেকে যে মেঘ এসে ভর করলো আকাশে! এখন রীতিমতো প্রবল বাতাস বইছে। সূর্য ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে, কমে এসেছে আলো। প্রকৃতির যে রূপ সেটা দেখে ভোরের মতো লাগছে নুরে ছফার কাছে।
একটু আগে দূর থেকে পেট্রল পাম্পটা দেখতে পেয়ে ট্যাক্সি ক্যাবের ড্রাইভারকে বলেছিলো, রাস্তার বামপাশে রাখতে গাড়িটা। ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সে। পেট্রল পাম্পটা যে পরিত্যক্ত সেটা বুঝতে একটুও দেরি হয়নি তার। যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে, দীর্ঘদিন থেকেই ওটা আর সচল নেই। মাঝারি আকারের ফ্রিজের মতো দেখতে ফুয়েল ডিসপেন্সরগুলো ধুলোয় মলিন। অফিস ঘরটিও বন্ধ, বাইরে থেকে বিশাল তালা ঝুলছে। প্রবল বাতাসে পাম্প স্টেশনের পাকা ছাউনির উপরে কোনোমতে ঝুলে থাকা সাইনবোর্ডটা দুলছে ক্যাচক্যাচ শব্দ করে। সামনের প্রাঙ্গনে ছোটোখাটো ধুলোর ঝড় বয়ে যাচ্ছে এখন।
পেট্রল পাম্প স্টেশনটা পেরিয়ে, আরেকটু সামনে গিয়ে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখেছিলো তিন বছর আগের পরিচিত জায়গাটা-এখনও ‘রবীন্দ্রনাথ’ টিকে আছে!
এখন অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সেই অদ্ভুত নামের রেস্টুরেন্টের সাইনটা বেশির ভাগ অংশ হারিয়ে এখনও টিকে আছে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ হয়ে! আগে যেটা রেস্টুরেন্টের সামনের প্রাঙ্গন আর পার্কিং এরিয়া ছিলো সেটা এখন ছোটোখাটো বাগান। সেই বাগানের মাঝখান দিয়ে দশ-বারো ফুটের মতো প্রশ্বস্ত একটি রাস্তা চলে গেছে প্রধান ফটক পর্যন্ত। দু-পাশের ফুলের বাগানটি বড়জোর কয়েক মাস আগে করা।
ছফা ভেবেছিলো এই স্থাপনাটি আর দেখতে পাবে না। কিংবা সেটা হয়তো পরিত্যক্ত অবস্থায় পাবে।
তিন বছর পর নুরে ছফা আবারো পা বাড়ালো রবীন্দ্রনাথের দিকে!
.
অধ্যায় ১৩
“ওইদিকে তাকায়া আছে ক্যান, মিয়া?”
কণ্ঠটা শুনে চমকে উঠলো রহমান, রবীন্দ্রনাথ থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেলো ইনফর্মার আতর আলী দাঁড়িয়ে আছে তার দোকানের সামনে। লোকটাকে দেখে অবাক হলো না সে। মাথা যখন দেখা গেছে লেজটা তো দেখা যাবেই!
“এক কাপ চা দাও,” টঙ দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চটায় বসে বললো আতর। “আর একটা বেনসনও দিও।”
আতর আর সেই আতর নেই, তার বেশভূষাও বেশ বদলে গেছে। আড়ালে আবডালে তাকে ইতর বলার লোকজনও দিন দিন কমে আসছে এখন। তবে রহমান মিয়ার কাছে সে সব সময়ই আস্ত একটা ইতরের বাচ্চা।
“এই অবেলায় এইহানে কী মনে কইরা?” প্রশ্নটার জবাব জানা সত্ত্বেও বেনসনের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো রহমান। “এটু বাদে তো তুফান আইবো।”
“কাম না থাকলে এই আতর মুততেও আইতো না তোমার দোকানে, তাচ্ছিল্যের সাথে বললো সুন্দরপুর থানার ইনফর্মার।