“পলিটিশিয়ানদের সাথে কাজ করনের ঝক্কি থাকে, আর এইটা বেশি ভোগায় সৎ অফিসারগো। কথাটা মাথায় রাইখেন।” তারপর একটু থেমে আবার বললো, “বেসিক্যালি, অল অব দেম আর বাস্টার্ডস! আপনে তো এখনও সার্ভিসে আছেন, আপনেও এইটা জানেন।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। তদন্তে রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ, নাক গলানো, প্রভাব বিস্তার করা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা এ দেশে। এ নিয়ে তার নিজের মধ্যেও কম তিক্ততা নেই। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করে, তাতে করে এই বাহিনীতে কর্মরতদের মধ্যে কেএস খানের বলা কথাটার বেশ প্রচলন আছে।
“আমি সেটা জানি, স্যার। তারপরও, যেভাবে কেসটা এগোচ্ছিলো তাতে করে তো কোনো কূলকিনারা করা যাচ্ছিলো না, এখন যদি ক্ষমতাবান কারোর কাছ থেকে সব ধরণের সাপোর্ট পাওয়া যায় তাহলে কি সেটা কাজে লাগানো উচিত না?”
ডিবির সাবেক কর্মকতা কিছুই বললো না। যাই হোক, এখন আপনের কাছে মুশকান জুবেরির একটা ছবি আছে…যদিও অনেক পুরানা কিন্তু মহিলার তো তেমন একটা চেঞ্জ হয় নাই, একই রকম আছে, তাই এই ছবিটা অনেক কাজে দিবো।”
“হুম,” সায় দিয়ে বললো ছফা। “ছবিটা হাতে পাবার পরই দ্রুত কাজে নেমে পড়েছি, স্যার। আমার দেখাটা হেলুসিনেশান নাকি সত্যি, সেটা যেহেতু নিশ্চিত করে জানি না তাই আমি আজকেই এয়ারপোর্টে গিয়ে সবগুলো সরকারী-বেসরকারী এয়ারলাইন্সে ছবি দিয়ে এসেছি। দেশের সবগুলো স্থলবন্দরে ফ্যাক্স করে দিয়েছি ছবিটা।”
“ভালো করূছেন,” একটু থেমে আবার বললো কেসকে। “ছবিটা সাকুলেট করা জরুরী ছিলো। ঐ মহিলা যদি দেশে ঢোকে কিংবা বাইর হওনেরও চেষ্টা করে, তাইলে সে ধরা পড়বো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “এখন তো আমি হাত-পা গুটিয়ে। বসে থাকতে পারি না। কিন্তু কোত্থেকে শুরু করবো সেটাই বুঝতে পারছি না।”
কেএস খানের মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো। সেই হাসি যেনো বহু অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। “সব সময় যেইটা আমি কই,” লম্বা করে সশব্দে চায়ে চুমুক দিলো সে। “যে মাটিতে আছাড় খাইছেন সেই মাটি থেইকাই আপনেরে উঠতে হইব।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো নুরে ছফা।
“আপনেরে ফিরা যাইতে হইবো সুন্দরপুরে।”
“সুন্দরপুরে?!” বিস্মিত ছফা ঠাণ্ডা চায়ে চুমুক দিলো। মুশকান পালিয়ে যাবার পর সুন্দরপুরে এমন কী আছে যে, ওখান থেকে মহিলাকে ট্র্যাক করবে? সুন্দরপুর থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিলো ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের উপরে। কিন্তু ভদ্রলোক তার হাত থেকে বাঁচতে বিদেশে চলে যান।
“ওখানে গিয়ে আমি কী খুঁজব?” প্রশ্নটা না করে পারলো না। “ঐ মহিলার সাথে সুন্দরপুরের কারোর সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। ঘটনার পর পরই ওখানকার মাস্টারের পেছনে আমার এক বিশ্বস্ত লোককে লাগিয়েছিলাম, কিছু পাইনি। ভদ্রলোক ট্রাস্টি হবার পর স্কুল বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমার মনে হয় না, মুশকান জুবেরি তার সাথে কোনো রকম যোগাযোগ রাখে।”
“তারপরও, আপনেরে যদি এই কেসটা আবার শুরু করতে হয়, তাইলে ওইখান থেইকাই শুরু করন লাগবো,” পুণরায় জোর দিয়ে বললো কেএস খান।
নুরে ছফা চুপ মেরে রইলো। অভিজ্ঞ এই ডিবি অফিসারের সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারছে না সে, কিন্তু এটা মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
“আপনের কথায় লজিক আছে…তয় পুরানা বাংলা প্রবাদটায় যদি আস্থা রাখেন, তাইলে সেইখান থেইকাই আপনেরে শুরু করতে হইবো আবার।”
.
অধ্যায় ১২
এক সময় দূর দুরান্ত থেকে যে রেস্তোরাঁয় ছুটে আসতো লোকজন, সেটার উল্টোদিকে, রাস্তার ওপারে চায়ের ছোট্ট টঙ দোকানের মালিক রহমান মিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে হতাশ হলো। কালো মেঘের পুঞ্জ জড়ো হচ্ছে, শেষ বিকেলে ধেয়ে আসছে কালবোশেখি ঝড়। চোখমুখ বিকৃত হয়ে উঠলো তার। ওয়াক থু শব্দ করে এক দলা থুতু ফেললো দোকানের পাশে।
আজ সারাটা দিন খুব গরম পড়েছিলো, কাস্টমারও খুব বেশি পায়নি। বিকেলের দিকে, সন্ধ্যার পর গ্রামের মানুষজন রোদের তাপ কমলে যে আড্ডা দিতে আসবে, কালবোশেখি মনে হয় সেটা হতে দেবে না। আখের গুড়ের যে পিণ্ডটা আছে তার উপরে কিছু মাছি বসেছে কিন্তু অন্য সব দিনের মতো সেগুলো তাড়িয়ে দেবার তাগাদা অনুভব করলো না। মনে মনে ঠিক করলো, আকাশের অবস্থা আরেকটু খারাপ হলেই দোকানের ঝাপি ফেলে বাড়ি চলে যাবে।
আকাশের দিকে আরেকটু ভালো করে তাকালো রহমান। সে নিশ্চিত, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড় হবে, সেই সাথে হবে বৃষ্টিপাত। এরইমধ্যে গুড়গুড় শব্দ তুলে মেঘ জানান দিচ্ছে সেটা। কালো কালো মেঘ ছুটে বেড়াচ্ছে আকাশে, পাগলা ষাড়ের মতো ফুঁসে উঠছে যেনো।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে আনতেই একটা দৃশ্য দেখে তার চোখ আটকে গেলো। তার টঙ দোকানের পাশ দিয়ে যে সড়কটা চলে গেছে তার ঠিক বামদিকে, পরিত্যক্ত পেট্রল পাম্পটার কাছে একটা ট্যাক্সিক্যাব এসে থেমেছে। গত আড়াই বছরে এটা বিরল ঘটনা। পাম্পটা বন্ধ হবার পর কোনো গাড়ি সেখানে থামতে দেখেনি।
উৎসুক হয়ে দেখলো, একটু পরই গাড়ি থেকে নামলো একজন। লোকটাকে দূর থেকে দেখেই চিনতে পারলো সে। যদিও প্রায় তিন বছর পর দেখলো তাকে। ক্ষমতাবান সেই লোকটি গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে হেঁটে দাঁড়িয়ে রইলো রবীন্দ্রনাথের সামনে।