সিগারেটটা শেষ করে রমনার বটমূলের দিকে পা বাড়ালো। মানুষের ভীড় এখন জনস্রোতে পরিণত হয়েছে। বটমূলের সামনে বসে থাকা দর্শক শ্রোতাদের দিকে চোখ বুলালো। রোদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বেশির ভাগ নারী-পুরুষ মাথার উপরে রুমাল, কাপড়, সানগ্লাস আর সানক্যাপ দিয়ে রেখেছে। তাদের প্রায় সবার চোখ বটবৃক্ষের শান বাঁধানো চত্বরে যে মঞ্চ বানানো হয়েছে তার দিকে থাকার কথা কিন্তু অনেকের দৃষ্টিই অন্যদিকে নিবদ্ধ-উপস্থিত দর্শকদের বিরাট একটি অংশ হাতে মোবাইলফোন নিয়ে নিজেদের অহংকে তুষ্ট করার জন্য অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে ছবি তোলায় ব্যস্ত।
সেল্ফি!
তিক্ততায় একদলা থুতু ফেললো সে। কালের এই উন্মাদনাকে মেনে নিতে একটু কষ্টই হয় তার। মানুষ এখন নিজেদের প্রতিটি মুহূর্তকে ধরে রাখতে চায়, জানান দিতে চায় তার উপস্থিতিকে! তাদের মতো ডিবি অফিসাররাও বড়সর কোনো ‘ক্রিমিনাল’কে ধরার পর সেল্ফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেয় আজকাল। এ নিয়ে ডিপার্টমেন্টে প্রায়শই বচসা বাধে, আর সেটা সব সময় শুরু করে ছফা নিজেই।
সেক্তি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সামনের দিকে তাকালো সে। বটবৃক্ষের শান বাঁধানো চত্বরে বসে বিভিন্ন বয়সের শ’খানেক নারী-পুরুষ গান গেয়ে যাচ্ছে। সূর্যালোকের কারণে চোখের উপরে হাত রেখে মঞ্চে বসা মানুষগুলোর দিকে নজর দিলো এবার। ভীড়ের মধ্যে কাউকে খোঁজার যে কৌশল সেটা তার জানা আছে। ধৈর্য ধরে এক এক করে দেখতে হয়। বিক্ষিপ্তভাবে দেখলে দৃষ্টি বিভ্রান্ত হবে।
হতাশার সাথেই এবার ফিরে তাকালো মঞ্চের সামনে বসে থাকা হাজারখানেক দর্শকের দিকে। এক এক করে দেখতে শুরু করলো সে। কিন্তু কয়েক মিনিট পরই তার দৃষ্টি চঞ্চল, অসহিষ্ণু আর উদভ্রান্ত হয়ে উঠলো। ক্রমশ হতাশা গ্রাস করলো তাকে। তিক্তমুখে ঘুরে দাঁড়ালো। আরেকটা সিগারেট ধরাবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। তবে তার পা দুটো ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, ভীড় থেকে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে যেনো।
এখানে হুট করে চলে আসাটা যে কতো বড় পাগলামি হয়েছে, সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মুশকান জুবেরি এতোটা বোকা নয় যে, হত্যা-গুমের অভিযোগ মাথায় নিয়ে পহেলা বৈশাখে ছুটে আসবে রমনার বটমূলে।
হাঁটতে হাঁটতেই পাশ ফিরে তাকালো সে। সমবেত কণ্ঠের গান থেমে গেছে, শুরু হয়েছে একক পরিবেশনা।
নাই বা ডাকো রইব তোমার দ্বারে,
মুখ ফিরালে ফিরব না এইবারে…
নিজেকে ভীষণ বোকা আর নাছোড়বান্দা বলে মনে হচ্ছে তার। তবে মুশকান জুবেরির ব্যাপারে আর কততদিন হাল না ছেড়ে থাকতে পারবে, জানে না। সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে যাবার পর তিন বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ছফার যৌক্তিক মন জানে, ঐ ভয়ঙ্কর নারী দেশ ছেড়েছে, হয়তো আর কখনও ফিরে আসবে না। ভিনদেশে গিয়ে দিব্যি পুরুষ শিকার করে যাচ্ছে সে, আর নিজেকে করছে কালোত্তীর্ণ!
মাঝে মাঝে সে ভাবে, নিজের অহংবোধকে তুষ্ট করার জন্যই সম্ভবত এখনও হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে মহিলাকে। এটা যে তার জন্যে প্রথম ব্যর্থ কেস হতে চলেছে, সেটা মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়, নিজের পেশার প্রতি দায়বদ্ধতাও…
“আশ্চর্য! চোখে দেখেন না নাকি!”
বিরক্তিভরা একটি নারী কন্ঠ বলে উঠলো তাকে উদ্দেশ্য করে।
আক্ষরিক অর্থেই প্রবলভাবে ঝাঁকি খেলো নুরে ছফার ভাবনাগুলো। বুঝতে পারলো, আনমনা থাকার কারণে চলতে চলতে এক মহিলার সাথে ধাক্কা লেগে গেছে। এখানে আসা অন্য সবার মতো এই মহিলাও লালপেড়ের সাদা সুতির শাড়ি পরেছে, মাথায় বেলি ফুলের মালা, কপালে লাল টিপ। মহিলাকে কিছু বলতে গিয়ে থমকে গেলো সে।
এখানে যে তাকে দেখতে পাবে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি!
.
অধ্যায় ১
“স্যার…আপনি?!”
নুরে ছফা যারপরনাই বিস্মিত। যে মেয়েটার সাথে তার ধাক্কা লেগেছে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাবেক ডিবি অফিসার কেএস খান।
“ইয়ে মানে…”
সলজ্জ মুখে কেবল বিব্রতকর হাসিটা ধরে রেখেছে ভদ্রলোক। যেনো লুকিয়ে প্রেম করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে।
“আপনি উনাকে চেনেন?” শাড়ি পরা তরুণী অবাক হয়ে বললো, একবার নুফে ছফা আরেকবার কেএস খানের দিকে তাকালো সে।
“আপনেরে বলছিলাম না ছফার কথা?” বিব্রত হাসিটা ধরে রেখেই বললো মি. খান। “এই হইলো সেই নুরে ছফা।”
ছেলে-ছোকরাদের মতো টকটকে লাল রঙের পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা আর পায়ে চপ্পল পরে আছে কেএস খান-একেবারে পহেলা বৈশাখের সাজে!
“আর ইনি হইলেন ডাক্তার লুবনা,” মেয়েটাকে দেখিয়ে বললো কেএসকে। মুখে বিব্রতকর হাসিটা যথাসম্ভব দূর করার চেষ্টা করছে সাবেক ডিবি অফিসার।
নুরে ছফা তরুণীর দিকে তাকালো আবার। মেয়েটার বয়স বেশি হলে ত্রিশ-বত্রিশ হবে। তবে সে নিশ্চিত নয়। মেয়েদের বয়স ধরার বেলায় সে যথেষ্ট আনাড়ি। তার কাছে পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের মেয়েরা হলো সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তিকর। কেএস খানের সঙ্গি মেয়েটিও একই রকম বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।
“সরি…” অবশেষে একটা ঢোঁক গিলে আস্তে করে বললো, “…ম্যাডাম।” মেয়েটাকে ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করা নিয়ে একটু দ্বিধা ছিলো মনে, তারপরও অনেকটা মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে, সম্ভবত কেএস খানের উপস্থিতির কারণে। “আমি আসলে…খেয়াল করিনি।”