এমন না যে, মোবাইলফোন না থাকলে তার অনেক সমস্যা হবে, যোগাযোগ করতে পারবে না কারোর সাথে। সত্যি বলতে, এই যুগেও তার সাথে বেশির ভাগ মানুষজন যোগাযোগ করে পুরনো আমলের ল্যান্ডফোনেই। কিন্তু একটা জিনিস হারিয়ে গেলো আর তার ইনভেস্টিগেটর সত্তা সেটার খোঁজ করবে না তা কি হয়? অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর ব্যর্থ হয়ে এখন বসে আছে চুপচাপ। ভাবার চেষ্টা করছে জিনিসটা গেলো কোথায়!
আইনস্টাইনও তার সাথে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। এমন সব জায়গায় খুঁজে দেখেছে যেখানে কেবলমাত্র ইঁদুর আর টিকটিকির পক্ষেই ঢোকা সম্ভব। এখন তাকে খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে চা আনতে পাঠিয়েছে।
এমন সময় ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলে কেএস খান আনমনেই ফোনটা তুলে নিলো।
“হ্যালো।” ডাক্তার লুবনার সুমিষ্ট কণ্ঠটা বলে উঠলো ওপাশ থেকে।
“আরে আপনে…আছেন কেমন?” পহেলা বৈশাখের পর আর মেয়েটার সাথে তার যোগাযোগ হয়নি। জরুরী একটা দরকারে গ্রামের বাড়িতে গেছিলো।
“ভালো আছি। আপনার কি অবস্থা?”
“ভালাই…সামান্য সর্দি ছাড়া আর সব ঠিক আছে।”
“অ্যালার্জি থেকে হয়েছে,..ঘরে অ্যালাট্রল আছে না?”
“আছে মানে, আমার ঘর তো ছোটোখাটো ডিসপেন্সারি,” কথাটা বলেই চওড়া হাসি দিলো কেএস খান। যদিও ফোনে সেটা দেখতে পাবে না ডাক্তার লুবনা।
“আমি আপনার মোবাইলফোনেও কল দিয়েছিলাম…বন্ধ পেলাম যে?”
“বন্ধ না…আসলে খুঁইজা পাইতাছি না।”
“হারিয়ে ফেলেছেন নাকি?”
“পয়লা বৈশাখের পর থেইকা পাইতাছি না। সারা ঘর খুঁইজা শেষ। কই রাখছি মনে করবার পারতাছি না। আমার আবার মেমোরি খুব উইক।”
“আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।”
“আমার মেমোরি?” বুঝতে না পেরে বললো সাবেক ডিবি কর্মকর্তা।
“আরে না,” হেসে বললো ডাক্তার। “ফোনের কথা বলছি। রমনা থেকে ফেরার সময় ফোনটা পিট পকেট হয়ে গেছে মনে হয়। আপনি তো পাঞ্জাবির পকেটে রেখেছিলেন ফোনটা।”
“হুম।” মাথা নেড়ে সায় দিলো কেএস খান। চাকরিজীবনে পকেটমারদের সাথে বেশ কয়েকবার মোলাকাত হয়েছে তার। এরকম এক পকেটমার তাকে একবার বলেছিলো, কেউ পাঞ্জাবির পকেটে কিছু রাখলে নাকি তারা ধরে নেয় জিনিসটা আসলে তাদের পকেটেই রাখা হয়েছে! “তাইলে সেইটাই হইছে…পকেটমার মাইরা দিছে।”
“খারাপ লাগছে?” আদুরে কণ্ঠে জানতে চাইলো ডাক্তার।
“আরে না।” একটু থেমে আবার বললো সাবেক ডিবি অফিসার, “আমি টিনেজ পোলাপান নাকি, মোবাইল হারাইলে মুখ বেজার কইরা বইসা থাকুন? এর আগে কতোবার আমার ফোন হারাইছে! এইটা কোনো ব্যাপারই না।”
“আমি যদি আপনাকে জোর করে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে না নিয়ে যেতাম তাহলে ফোনটা হারাতো না,” বিষণ্ণ কণ্ঠে ওপাশ থেকে বললো ডাক্তার।
“কী যে বলেন না,” কেএস খান সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলো মেয়েটাকে। “ফোন তো হারায়ই…এইটা আর এমন কী।”
একটু চুপ থেকে ডাক্তার লুবনা বললো, “ঐদিন আপনার ছাত্র…ঐ যে, নুরে ছফা…সে আমাদের একসাথে দেখে ফেলায় কি আপনার কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“আরে না, কেএসকে বললো। “ছফা আমার খুবই ঘনিষ্ঠ মানুষ…এইটা কোনো ব্যাপার না। আমি কার সাথে কই যামু না যামু এইটা নিয়া সে ক্যান ভাবতে যাইবো? আর ভাবলেই আমি পরো
“হুম। তা তো ঠিকই,” সায় দিলো ডাক্তার লুবনা।
“আপনে এইটা নিয়া খামোখা ভাবতাছেন। এইটা কোনো ব্যাপারই না।”
“আসলে আমার মনে হলো আপনি খুবই বিব্রত হয়েছিলেন, তাই বললাম।”
“আরে না, সেইরকম কিছু না…বুঝতেই পারছেন, জুনিয়রদের সামনে পইড়া গেলে তো একটু ইয়ে হয়-ই।”
ডাক্তার লুবনা হেসে ফেললো। “যাক, বাঁচলাম। আমি তো ভেবেছিলাম আপনাকে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছি।” একটু চুপ থেকে আবার। বলে উঠলো সে, “কাল বিকেলে কি ফ্রি আছেন? ভাবছি, একটু কফি খেতে যাবো।”
আনন্দে মুখে হাসি ফুটে উঠলো সাবেক ডিবি অফিসারের। “আপনে ঢাকায় এখন?”
“হুম। আজ দুপুরে এসেছি।”
চওড়া হাসি ধরে রেখেই বললো, “আমি তো ফ্রিই আছি, কোনো সমস্যা নাই।”
“দ্যাটস গ্রেট।” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো ডাক্তার লুবনা।
“কয়টার দিকে বাইর হইবেন?”
“বিকেলে পাঁচটায়?”
“ওকে…ননা প্রবলেম…কোন্ জায়গায় আসতে হইবো, কন?”
“ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবরে চলে আসুন। আমি ওখানেই থাকবো।”
“ওকে।”
“রাখি। বাই। কাল বিকেলে দেখা হচ্ছে তাহলে, মিষ্টি করে হেসে বললো ডাক্তার লুবনা।
“বাই, কলটা কেটে গেলেও কেএস খান ফোনটা কানে চেপে রাখলো আরো কিছুক্ষণ। সেই সুপরিচিত হৃদস্পন্দনটা টের পেলো। এক ধরণের ধুকপুকানি। নতুন প্রেমে পড়লে যেমনটা হয়। ডাক্তার লুবনার সাথে প্রতিবার কথা বললেই এটা হয় তার।
ফোনটা রেখে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আবার রিং বেজে উঠলো, বিরক্ত হয়েই ফোনটা তুলে নিলো সে।
“কী খবর তোমার?” এবার নিয়মমাফিক কলটা এসেছে।
“এই তো…আছি,” বললো মহিলার সাবেক স্বামী।
“তোমার ফোন খুঁজে পেয়েছো?”
গতকাল ফোন করলে সাবেক স্ত্রীকে মোবাইলফোন হারানোর কথা জানিয়েছিলো সে। “না। ওইটা আসলে পিট পকেট হইছে মনে হয়।”
“বলো কি!” অবাক হলো ফোনের অপর পাশের কণ্ঠটা। “কাল না বললে হারিয়ে ফেলেছিলে?”
“হ…কিন্তু আজ মনে হইতাছে পয়লা বৈশাখে যে রমনায় গেছিলাম, সেইখান থেইকা ফিরা আসার সময়…” কথাটা শেষ করার আগেই কেএস খান বুঝে গেলো বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছে। এখন কী প্রতিক্রিয়া আর প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সেটা বুঝতে এক সেকেন্ডও লাগলো না।