“তাহলে এখানে থাকে কারা?”
বাড়িটার সামনে, সিঁড়ির দিকে তাকালো মুশকান, তার দৃষ্টি অনুসরণ করলো মেয়েটি। সিঁড়ির দু-পাশে দুটো আবক্ষ মূর্তি দেখতে পেয়ে অবাক হলো সুস্মিতা।
“এটা রবীন্দ্রনাথের বাড়ি!” বিস্ময়ের চেয়ে অবিশ্বাসই বেশি তার অভিব্যক্তিতে। “ওটা আবার কার স্ট্যাচু?” ভুরু কুঁচকে সিঁড়ির ডান দিকে থাকা আবক্ষ মূর্তিটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে।
“মৃণালিনী দেবীর,” বললো মুশকান। “রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিনী।
“আমি জানতাম না এখানেও রবীন্দ্রনাথের বাড়ি ছিলো।”
“এটা ওর শ্বশুড়বাড়ি,” শুধরে দিলো মুশকান।
“তুমি এতোদিন এখানে ছিলে?” আশাহত দেখালো সুস্মিতাকে।
মুশকান কিছুই বললো না।
“তাহলে তো ইচ্ছে করলে আমাকেও এখানে এনে রাখতে পারতে,” অন্যদিকে তাকালো অভিমানে। “তুমি আসলে চাওনি…আমি জানি।”
“হ্যাঁ, চাইনি,” সরাসরিই বললো মুশকান। “আর কেন চাইনি সেটা তুমিও ভালো করে জানো।”
ভুরু কুঁচকে তাকালো আসকারের মেয়ে।
“তুমি ভুলে যাও আমি তোমার বাবার বন্ধু।”
ঠোঁট বাঁকালো সুস্মিতা। “বাবার বন্ধু…মা তো নও!”
মুশকান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাম দিকের বিশাল ঝিলের দিকে তাকালো।
“যাই হোক, এখন তো আমরা এখানেই থাকবো, তাই না?”
কিছু বললো না মুশকান।
সুস্মিতা মুগ্ধ হয়ে দেখলো আশপাশটা। “অনেক সুন্দর জায়গা! আই জাস্ট লাভ ইট। এই জায়গাটা কিন্তু ওই সাফা না ছফা…খুঁজে বের করতে পারবে না।”
মেয়েটার দিকে তাকালো মুশকান। ছফা এখন পর্যন্ত যা করেছে সেটা আমলে নিলে, নিশ্চিন্তে থাকার কোনো সুযোগই নেই। তার মনের কোণে একটি আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছে-সে এখানেও চলে আসবে! এ জায়গায় বেশি দিন থাকা সম্ভব হবে না হয়তো।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। সম্ভবত বাকিটা জীবন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়েই বেড়াতে হবে তাকে।
“কিন্তু ছফার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে…আমাদেরকে,” গম্ভীর কণ্ঠে বললো সে।
তার দিকে ফিরে তাকালো সুস্মিতা।
“ভুলে যেও না, ও কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে গেছিলো। আমাদের সব কিছু জেনে গেছে।”
কয়েক মুহূর্ত স্থিরচোখে চেয়ে রহস্যময় হাসি দিলো মেয়েটি। ধীরপায়ে মুশকানের কাছে এসে দাঁড়ালো সে। “ওকে নিয়ে একদম ভাববে না!”
সামান্য চোখ কুঁচকালো মুশকান।
“ও যদি এখানে চলে আসে, সেটা হবে ওর জীবনের শেষ টুর!”
মাথা দোলালো মুশকান। “আমরা ওরকম কিছুই করবো না, ঠিক আছে?”
এ কথার কোনো জবাব দিলো না মেয়েটি। “শোনো, আপাতত ওর চিন্তা বাদ দাও,” বলেই চারপাশে চোখ বুলালো আবার। “এখন শুধু তুমি আর আমি! ঠিক আছে?”
মুশকান কিছু বলার আগেই পা থেকে জুতোটা খুলে সবুজ ঘাসের উপর হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো সুস্মিতা, আকাশের দিকে মুখ করে মুক্তির স্বাদ নিলো বুকভরে, গুণগুণিয়ে গেয়ে উঠলো একটা গান :
“কেন গো সে মোরে যেনো করে না বিশ্বাস।
কেন গো বিষণ্ণ আঁখি আমি যবে কাছে থাকি,
কেন উঠে মাঝে মাঝে আকুল নিশ্বাস।
আদর করিতে মোরে চায় কতবার,
সহসা কী ভেবে যেনো ফেরে সে আবার…”
মুশকানের চোখেমুখে বিব্রত ভঙ্গি ফুটে উঠলো। শক্ত নার্ভের মানুষ হিসেবে এটা তার জন্য বিরলতম অভিজ্ঞতা! কিন্তু গানের মাঝখানে বাধা দিতে মন সায় দিলো না। মেয়েটা দারুণ গায়। তারপরও দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার চেষ্টা করলো সে।
“প্রাণেশ সমাদ্দারের সাথে রবীন্দ্রনাথের শ্বশুড় বেণীমাধবদের বেশ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিলো…পাশাপাশি বাড়িতে থাকতো ওরা।”
গান থামিয়ে পেছন ফিরে তাকালো সুস্মিতা। “রবীন্দ্রনাথ বোধহয় খুব ঘন ঘন আসতেন এখানে, তাই না? বাঙালি পুরুষগুলো তো আবার শ্বশুড়বাড়ি নিয়ে ভীষণ ফ্যাসিনেটেড। শ্বশুড়বাড়ি মধুর হাড়ি-এরকমটা বলে না?” বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। “ঐ মেলশোভনিস্ট পিগৃগুলো যে মধুর হাড়ি বলতে কী বোঝায় আমি জানি।”
“শ্বশুড়বাড়ির আদর-আপ্যায়নকে বোঝায়, আর কী বোঝাবে, আজব!”
হা-হা-হা করে হেসে উঠলো সুস্মিতা। “তুমি মেলশভনিস্ট পিগগুলোর সাইকোলজিটাই বুঝতে পারো না।”
কিছু বললো না মুশকান।
“ওরা আসলে অল্পবয়সী শ্যালিকাদেরকেই মধুর হাড়ি বুঝিয়েছে!”
মাথা দোলালো সে। এসব আলাপ করতে ভালো লাগছে না তার। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। যে জায়গাতেই সে কিছু দিন থাকে সে জায়গার উপরে তার মায়া পড়ে যায়, এই জায়গাটার উপরেও মায়া জন্মে গেছে এ কয়দিনে।
“ওঁর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে, তাই না?”
সুস্মিতার কথা শুনে পরিহাসের হাসি ফুটে উঠলো মুশকানের ঠোঁটে। আদতে রবীন্দ্রনাথ যে শ্বশুড়ালয়ে এসেছিলেন তার কোনো স্মৃতি এখানে নেই। এ নিয়ে বেশ ধোঁয়াশা আছে। কবির শ্বশুড়বাড়িটা খুলনার পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠলেও সত্যিটা বেশ অবাক করার মতো। কপ্লেক্সের প্রবেশপথে এবং ভেতরে রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিনী মৃণালিনী দেবীর বাড়ি সম্পর্কে যে তথ্য দেয়া আছে তার কোথাও উল্লেখ নেই, রবীন্দ্রনাথ কখনও এ বাড়িতে এসেছিলেন কিনা। বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যদিও জানা যায়, বিয়ের আগে, ১৮৮৩ সালের দিকে বেনীমাধব রায় চৌধুরীর যে বাড়িটি এখানে ছিল সেটি ছিলো টিনের তৈরি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার একমাত্র মেয়ে ভবতারিনী দেবী, ওরফে ফেলীর বিয়ের পর নাকি এখনকার অবকাঠামোটি তৈরি করা হয়। তবে কে এটা তৈরি করেছে সেটা নিয়েও আছে অস্পষ্টতা। স্থানীয়দের অনেকেই বলে থাকে, বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথ নিজেই এটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিকেরা অবশ্য এর কোনো প্রামাণ্য তথ্য পায়নি। তবে রবীন্দ্রনাথ যে দক্ষিণডিহি গ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কন্যাদর্শনের কাজটি সম্ভবত সেরেছিলেন এ গ্রামেই তার এক মামার বাড়িতে। মজার ব্যাপার হলো, ঠাকুরবাড়ির অনেক মেয়েই এসেছিলো এই দক্ষিণডিহি গ্রাম থেকে। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরমা থেকে শুরু করে নিজের মাসহ কয়েকজন বৌদিও এই গ্রামেরই মেয়ে। এখানে কবির বেড়াতে আসাটা তাই স্বাভাবিকই ছিলো, তবে এখন যে ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে সেই বাঁটে কবির পায়ের চিহ্ন কখনও পড়েছে বলে কোথাও উল্লেখ নেই। ঠাকুরবাড়িতে আবার অদ্ভুত বিয়ের রীতি ছিলো-পাত্র নয়, কন্যাপক্ষ চলে যেতো পাত্রের বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের বিয়েটাও ওভাবেই হয়েছিলো।