তার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিলো, এই ডিবি অফিসার তাদের এখানকার অবস্থান জেনে গেছে, পিএসের বাড়ি থেকে বের হবার সময় বেশ সতর্ক ছিলো সে, তারপরও ছফা কিভাবে জেনে গেলো?
মুশকানের শক্ত নার্ভ আজ রাতে আরেকবার টলে গেছিলো, কিন্তু বরাবরের মতোই দ্রুত নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। জানালার পর্দার আড়াল থেকে ছফার মধ্যে অস্থিরতাও দেখতে পায় সে। বার বার ঘড়ি দেখছিলো সে। মুশকান ভড়কে না গিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ঘটনা কি-তাদের বাড়িটা এখনও চিহ্নিত করতে পারেনি, তবে যেভাবেই হোক, ডিবি অফিসার জেনে গেছে এখানকার কোনো এক বাড়িতেই আছে তারা!
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়-এখান থেকে বেরুতে হবে। ছফার হাত থেকে বাঁচতে হবে।
কিন্তু কিভাবে?
নীচে একটা গাড়ি আছে, আসকার তার বিশ্বস্ত একজনকে পাঠিয়েছে। তাদেরকে এখান থেকে নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য। আরেকটু পরই তাদের রওনা দেবার কথা।
মুশকান গভীর করে শ্বাস নিয়ে নেয় বেশ কয়েক বার। স্নায়ুকে স্থির করে মাথা খাটাতে থাকে দ্রুত। তারপরই ঠিক করে, কী করতে হবে। চট করে ঘড়ি দেখে নেয় সে। যে কাজটা করবে, তার জন্যে সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করে জানিয়ে দেয় ছফার কথা। তাদের পরিকল্পাটা আগের মতো থাকলেও সামান্য পরিবর্তন করতে হবে। তার কাছ থেকে সব শুনে ডাক্তার দ্রুত কাজে নেমে পড়েন।
মুশকানকে সামান্য চিন্তিত দেখে সুস্মিতা জানতে চেয়েছিলো কিছু হয়েছে কিনা, কিন্তু তাকে কিছু বলেনি। শুধু বলেছে, একটু পরই তারা এ বাড়ি থেকে বেরুবে। সুস্মিতা কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ ড্রইংরুমে গিয়ে টিভি ছেড়ে দিয়ে একের পর চ্যানেল ব্রাউজ করতে শুরু করে দেয়।
ডাক্তারের কাছ থেকে ফোন পেয়ে জানালার সামনে আবারো দাঁড়ায় মুশকান। ছফা আর তার সহযোগী কথা বলছে। আসকারকে সে বলে দেয়, কী করতে হবে। আরেকটা ফোনে ডাক্তারের সাথে তার বিশ্বস্ত লোকটা সংযুক্ত থাকায় তিনি সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেন। আর তখনই মুশকান দেখতে পায় ছফা আর তার সহযোগীর কাছে এসে দাঁড়ায় পুলিশের একটা জিপ আর পিকআপভ্যান। গাড়ি থেকে পুলিশের দলটি নেমে ছফার সাথে কথা বলতে থাকে। দৃশ্যটা দেখে ভড়কে যায় মুশকান। দেরি না করে ডাক্তারকে বলে দেয়, নীচে তার যে বিশ্বস্ত লোকটা আছে সে যেনো এখন বাড়ি থেকে বের না হয়! আসকার জানতে চান কী হয়েছে, কিন্তু মুশকান আর তাকে কিছু বলেনি, শুধু একটু অপেক্ষা করতে বলে তাকে।
এর পরই দেখতে পায়, পিস্তল হাতে পুলিশদের দলটি নিয়ে বাঁ-দিকের কয়েকটিবাড়ির পরের একটি বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ডিবি অফিসার। দ্রুত বুঝে যায় মুশকান। আর দেরি করা সম্ভব নয়। ডাক্তারকে সে বলে দেয়, তার ঐ লোক যেনো এক্ষুণি বের হয়ে যায়।
একটু পরই জানালা দিয়ে সে দেখতে পায় নীচের মেইনগেটটা খুলে ফেলছে দারোয়ান। আর গেট খোলার ঘরঘর শব্দ শুনে ছফাসহ পুলিশের দলটি সেদিকে তাকায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য মুশকানের মনে হয়েছিলো, তার পরিকল্পনাটা বুঝি ভেস্তে গেলো। এর পরই যে গাড়িটা তাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছিলো সেটা বেরিয়ে পড়ে হেডলাইট না জ্বালিয়ে। গাড়িটা দেখামাত্রই ছফা কালক্ষেপন করেনি, পিস্তল উঁচিয়ে ছুটে যায়, গাড়িটাকে থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আসকারের বিশ্বস্ত লোকটা তখন গতি বাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করে। ছফার সহযোগী নিজের বাইকের দিকে ছুটে গিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে দেয়, ছফাও চড়ে বসে বাইকের পেছনে। পুলিশের দলটিও দৌড়ে তাদের জিপ আর পিকআপ ভ্যানে উঠে পড়ে।
এটাই চেয়েছিলো মুশকান!
সুস্মিতাকে নিয়ে দ্রুত নীচে নেমে আসে সে। বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় তারা দু-জন। আসকারের সাথে তখনও ফোনে যুক্ত ছিলো। এর আগেই তাকে বলে দিয়েছিলো, কী করতে হবে। সে জানতো, ছফাকে খুব বেশিক্ষণ ফাঁকি দিতে পারবে না আসকারের ঐ লোক। সুতরাং তাদের হাতে সময় খুব কম।
যে বাড়িতে তারা ছিলো, সেই বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা বাড়ির পরই সাত নাম্বার রোডটার মোড়। সেখানে এসে আসকারকে বলে দেয়। জায়গাটার অবস্থানের কথা, তারপর অপেক্ষায় থাকে সুস্মিতাকে নিয়ে। অরিয়েন্ট হাসপাতাল থেকে আরো আগেই একটা অ্যাম্বুলেন্স রওনা দিয়ে দিয়েছিলো বারিধারার উদ্দেশ্যে, আসকার সেই গাড়ির ড্রাইভারকে বলে দেন মুশকানদের অবস্থানের কথা।
কিছুক্ষণ পরই অরিয়েন্ট হাসপাতালের লাশ পরিবহনের কাজে নিয়োজিত সেই অ্যাম্বুলেন্সটি এসে হাজির হলে হাফ ছেড়ে বাঁচে মুশকান। সুস্মিতাকে নিয়ে দ্রুত উঠে বসতেই গাড়িটা ছুটতে শুরু করে নিঃশব্দে-ছফা আর পুলিশের দল যেদিকে গেছে, ঠিক তার বিপরীত দিক দিয়ে।
এখন নিশুতি রাতে প্রায় ফাঁকা এই শহরে দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে সেই অ্যাম্বুলেন্সটি। গাড়ির ভেতরে ছোট্ট উইন্ডোটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে মুশকান। রাস্তায় জ্যাম না থাকায় তাদের জন্য সুবিধাই হয়েছে। তবে সেই অস্বস্তি আবারো তাকে জেঁকে ধরেছে। কিছু একটার গন্ধ পাচ্ছে সে-ভয়ঙ্কর কিছুর।
“তুমি ওই লোকটার সাথে আর কিছু করোনি তো?” সুস্মিতার দিকে ফিরলো সে, কথাটা আর না বলে পারলো না।
“ওকে আবার কী করবো?” অবাক হবার ভান করলো মেয়েটা।