পিস্তলটা আবারো উঁচিয়ে ধরলো সে-একেবারে ড্রাইভিং ডোরের কাঁচ বরাবর। আর তখনই গাড়িটার গতি আরেকটু বেড়ে গেলো, সেই সঙ্গে দ্রুত চাপতে শুরু করলো ডানদিকে। বাইকের গতি কমিয়ে গাড়িটার পেছনে চলে আসতে বাধ্য হলো জাওয়াদ, নইলে গাড়িটার সাথে ধাক্কা খেতো তার বাইক।
জাওয়াদ তার বাইকের গতি কমিয়ে প্রাইভেটকারের পেছনে চলে আসতেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো, কিন্তু ততোক্ষণে বড় দেরি হয়ে গেছে। গাড়িটা আচমকা গতি কমিয়ে, সজোরে ব্রেক কষে ফেললো। জাওয়াদ না পারলে তাল মিলিয়ে গতি কমাতে, না পারলে ঠিক সময়ে ব্রেক কষতে। তার বাইকের সামনের চাকা গাড়ির পেছনের বাম্পারে গিয়ে সজোরে আঘাত হানলো।
জাওয়াদ দেখতে পেলো, বাম্পারের সাথে আঘাত লাগতেই তার বাইকের সামনের চাকা বামদিকে ঘুরে গেলো পুরোপুরি! হাত থেকে ছুটে গেলো বাইকটার নিয়ন্ত্রণ, সজোরে বাড়ি খেলো গাড়ির বুটের সাথে। জাওয়াদ শুধু টের পেলো তার ডান পা-টায় জোরে আঘাত লেগেছে, সেই সঙ্গে শুনতে পেলো নুরে ছফার চিৎকারটা : “জাওয়াদ!”
বাইকসহ রাস্তায় পড়ে গেলো জাওয়াদ আর ছফা। তবে পেছনে বসার কারণে গাড়ির সাথে আঘাত হানার আগেই লাফিয়ে রাস্তায় পড়ে গেছিলো নুরে ছফা। তাদের কারোরই মাথায় হেলমেট নেই, ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যেতো আরেকটুর জন্যে। ছফা দেখতে পেলো, জাওয়াদ বাইকসহ পড়ে গেলেও তার মাথা রাস্তার পিচে গিয়ে আঘাত হানেনি। তবে ছেলেটার ডান পা আহত হয়েছে নির্ঘাত।
রাস্তায় পড়ে থেকেই ছফা দেখতে পেলো সাদা রঙের গাড়িটা আচমকা ব্রেকমুক্ত হয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে গেলো আবার। রাস্তায় আছড়ে পড়লেও হাত থেকে পিস্তলটা বেহাত হয়নি ছফার। রাস্তায় শুয়ে থাকা অবস্থায়ই সে গাড়ি লক্ষ্য করে পর পর দুটো গুলি চালালো। নিস্তব্ধ এলাকা প্রকম্পিত হলো গুলির শব্দে। তার লক্ষ্য ছিলো গাড়িটার পেছনের চাকাদুটো, কিন্তু একটা গুলিও লক্ষ্যভেদ করতে পারলো না। গতি বাড়িয়ে গাড়িটা ছুটে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ব্যাকআপ টিমের জিপ আর ভ্যানটা দূর থেকে দেখেছে সব কিছু। জিপটা ছফাদের অতিক্রম করে চলে গেলেও ভ্যানটা থামলো তাদের কাছে
এসে। গাড়ি থেকে তিন-চারজন পুলিশ নেমে এলো দ্রুত।
“ওকে দেখো,” জাওয়াদকে দেখিয়ে বললো সে, হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দেখতে পেলো বাইকের নীচে চাপা পড়ে আছে জাওয়াদের একটা পা। পুলিশদের দু-জন বাইকটা ধরে তুলে ফেললো, অন্য এক জন তুলে দাঁড় করালো জাওয়াদকে। ডান পা-টা সামান্য শূন্যে তুলে রেখেছে। সে।
“তুমি ঠিক আছো?”
“পা-টা ভেঙে গেছে মনে হয়,” তীব্র যন্ত্রণায় চোখমুখ কুঁচকে বললো ছেলেটা।
“ওকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাও,” পুলিশদের বললো ছফা।
অমনি একজন পুলিশের ওয়াকিটকি ঘর্ঘর শব্দ করে উঠলো, একটা কণ্ঠ বলে উঠলো : “চার্লি টু। আমরা গাড়িটা আটকে ফেলেছি…এগারো নাম্বার রোডের শেষে…প্রগতি সরণীতে যাবার আগে যে মোড়টা আছে সেখানে!”
“স্যার, ওরা গাড়িটাকে আটকে ফেলেছে!”
ওয়াকিটকিটা পুলিশের কাছ থেকে প্রায় কেড়ে নিলো ছফা। “চার্লি টু…সাবধান! গাড়িতে যে মহিলা আছে সে খুবই ডেঞ্জারাস! আগেই বলেছি, ওর কাছে পিস্তল আছে! সবাই সাবধান! আমি আসছি।” জাওয়াদের দিকে ফিরলো চট করে। “কাছের একটা হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স আসতে বলো…আমি ভ্যানটা নিয়ে যাচ্ছি।”
“সাবধানে, স্যার!” জাওয়াদ বললো।
কিন্তু নুরে ছফা সেটা শুনলো কি শুনলো না বোঝা গেলো না, সে ততোক্ষণে পুলিশের পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভিং সিটের পাশে উঠে বসেছে। ভ্যানটা চলতে শুরু করলো দ্রুত।
এগারো নাম্বার রোডের মোড়ের কাছে আসতেই ছফা দেখতে পেলো, সাদা রঙের প্রাইভেটকারটি রাস্তার বামপাশে থেমে আছে, আর তার সামনে আড়াআড়ি করে রাখা আছে পুলিশের জিপটা। তিনজন পুলিশ সেই জিপকে ঢাল বানিয়ে নিজেদের রাইফেল আর পিস্তল তাক করে রেখেছে প্রাইভেটকারটার দিকে।
পুলিশের পিকআপ ভ্যানটা প্রাইভেটকারের দশ গজ পেছনে এসে থেমে গেলো, দ্রুত পিস্তল হাতে নেমে পড়লো ছফা। টের পেলো হাটু আর বাম কনুইতে ব্যথা করছে। সম্ভবত ছিলে গেছে। এসব তুচ্ছ বিষয়কে পাত্তা না দিয়ে সে অরক্ষিতভাবেই পিস্তল হাতে এগিয়ে গেলো গাড়িটার দিকে।
সাদা রঙের গাড়িটার সব দরজা বন্ধ, ভেতর থেকে কেউ তখনও বের হয়ে আসেনি। পুলিশের একজন ওয়ার্নিং দিচ্ছে চিৎকার করে : “অস্ত্রটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দাও!”
“স্যার, সাবধানে!”
পুলিশদের মধ্যে আরেকজন বলে উঠলো, কিন্তু ছফা গ্রাহ্যই করলো না। প্যাসেঞ্জার ভোরের দিকে পিস্তল তাক করে হুঙ্কার দিলো সে : “দরজা খোলো, মুশকান!”
কোনো সাড়া না পেয়ে ছফা আবারো হুঙ্কার দিতে যাবে, অমনি খট করে ডোরলক খোলার শব্দটা শুনতে পেলো। ডান হাতের পিস্তলটা তাক করে রেখেই বাঁ হাত দিয়ে দরজার হ্যাঁন্ডেলটা টান দিলো সে।
কিন্তু পেছনের সিটে কেউ নেই।
.
অধ্যায় ১০০
কিছুক্ষণ আগে বারিধারার পার্ক রোডে অরিয়েন্ট হাসপাতালের মালিকানাধীন একটি অ্যাপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মুশকান দেখতে পায়, রাতের এ সময়েও নির্জন রাস্তায় একজন লোক সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে পায়চারী করছে আর ভবনগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তার একটু দূরেই বাইক চালক কানে ইয়ারফোন গুঁজে কথা বলে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখলেও পায়চারী করতে থাকা নুরে ছফাকে চিনতে পারে সে!