গভীর রাতে বারিধারার পার্ক রোডে প্রবল উত্তেজনায় সিগারেট খেতে খেতে পায়চারী করতে লাগলো ছফা। পার্কের বিপরীতে থাকা বাড়িগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার। এইসব বাড়িগুলোর যেকোনো একটাতেই আছে। মুশকান জুবেরি। সম্ভবত সুস্মিতাও।
তার থেকে একটু দূরে স্ট্যান্ডের উপর রাখা আছে জাওয়াদের বাইকটা। সে আবারো ডিএমপি’র সাথে কথা বলে যাচ্ছে। এখানকার থানার যে কয়টি পুলিশ পেট্রল টিম আছে তাদের সবচেয়ে কাছেরটা পাঠানোর অনুরোধ জানাচ্ছে এবার। সে-ও বুঝতে পারছে, ঘটনার গুরুত্ব।
ছফা অধৈর্য হয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকালো। স্থানীয় থানায় ব্যাকআপ চেয়ে কল করার পর তিন-চার মিনিট সময় অতিক্রান্ত হলেও এরইমধ্যে বেশ কয়েক বার ঘড়ি দেখে ফেলেছে।
ছফার দিকে এগিয়ে এলো জাওয়াদ। “এক্ষুণি এসে পড়বে, স্যার।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “ওর কাছে পিস্তল আছে।”
সহকারী বুঝতে পারলো কার কথা বলছে। আমাদের কাছেও আছে।”
“তারপরও, খুব সাবধানে থাকতে হবে। আমি কোনো রকম ক্যাজুয়ালটি চাই না।”
“জি, স্যার।”
“আমরা যদি লোকেট করতে পারি, এখানে কোন্ বাড়িতে মুশকান আছে তাহলে ধরে নাও, সে কাউকে জিম্মি করতে পারে…খুবই মরিয়া হয়ে উঠবে সে…ধরা দিতে চাইবে না।”
জাওয়াদ কিছু বলতে যাবে, অমনি দেখতে পেলো দূরের রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে স্থানীয় থানার ব্যাকআপ টিম। ছফাও সেদিকে তাকালো। জোরে জোরে সিগারেটে টান দিয়ে কয়েক পা সামনের দিকে এগিয়ে গেলো সে। পুলিশের একটা জিপ আর পিকআপভ্যান এসে থামলো তার সামনে। গাড়ি থেকে পাঁচ-ছয়জন পুলিশ নেমে এলো, স্যালুট দিলো ছফাকে।
দলটির নেতৃত্বে যে এসআই আছে তার বুকে নেমপ্লেটে লেখা আছে। সমীর। সে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিলো।
“এখানকার দশ-বারোটা বাড়ি সার্চ করতে হবে,” সিগারেটে টান দিয়ে বললো ছফা। “আমরা সার্চ টিম হিসেবে কাজ শুরু করবো এখন।”
“জি, স্যার।”
“আসুন আমার সাথে,” বলেই পুলিশের ছোটোখাটো দলটি নিয়ে সামনের একটি বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো ছফা। “এই বাড়ি থেকে এক এক করে সবগুলো বাড়ি সার্চ করবো।”
“সাসপেক্ট কয়জন, স্যার?”
“একজন,” সুস্মিতাকে বিপজ্জনক হিসেবে দেখছে না সে। “তবে মহিলা দেখে আন্ডারএস্টিমেট করবেন না।”
মহিলা সাসপেক্টের কথা শুনে সমীর নামের এসআই বেশ অবাক হলো।
“সাসপেক্টের কাছে পিস্তল আছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো পুলিশ।
“মহিলা দেখতে ত্রিশ-বত্রিশের মতো,” জানিয়ে দিলো ছফা।
নিজের টহল দলের দিকে ফিরলো এসআই। “সাসপেক্ট মহিলা। ত্রিশের মতো বয়স। পিস্তল আছে তার কাছে। সবাই সাবধান!” এরপর ছফার দিকে ফিরলো সে। “চলুন, স্যার।”
নিজের কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে সেফটি লক খুলে রাখলো নুরে ছফা। এটা দেখে এসআই সমীরও তার পিস্তলটা হোলস্টার থেকে বের করে নিলো। একই কাজ করলো জাওয়াদ।
কিন্তু ছফার নেতৃত্বে প্রথম বাড়িটার মেইগেটের সামনে এসে কলিংবেল বাজাতেই ঘরঘর একটা শব্দ শুনতে পেলো তারা। পাশ ফিরে তাকালো সবাই। তাদের থেকে পাঁচ-ছয়টা বাড়ির পরের বাড়িটার মেইনগেট খোলা হচ্ছে ভেতর থেকে। তারপরই সেখান থেকে বের হয়ে এলো সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার-যে গাড়িটাকে ছফা এতোক্ষণ ধরে খুঁজছে!
গাড়ির হেডলাইট জ্বালানো নেই, ইনসাইড লাইটও বন্ধ। তাই দেখা গেলো না কে চালাচ্ছে-পেছনের যাত্রিই বা কারা। দেরি না করে ছফা পিস্তল হাতেই দৌড়ে গেলো সেদিকে। জাওয়াদ আর বাকি পুলিশের দলটিও একই কাজ করলো।
কিন্তু ছফা চিৎকার করে পিস্তল উঁচিয়ে গাড়িটাকে থামার জন্য বলতেই সেটা আচমকা গতি বাড়িয়ে ছুটে গেলো রাস্তার ডান দিক দিয়ে। পলায়নরত গাড়িটাকে গুলি করবে কিনা দ্বিধায় পড়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত পিস্তল নামিয়ে সহকারীর বাইকের দিকে ছুটে গেলো সে। জাওয়াদও ততোক্ষণে দৌড়ে চলে এসেছে তার বাইকের কাছে।
“আপনারা আপনাদের গাড়িতে উঠুন!” চিৎকার করে পুলিশের টহল দলটিকে বললো ছফা।
বাইকটা স্টার্ট দিতেই পেছনে উঠে বসলো নুরে ছফা। জাওয়াদ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলো গাড়িটাকে ধরার জন্য।
নির্জন রাতে এরকম জনমানবশূন্য রাস্তায় প্রচণ্ড গতি তুলতে কার্পণ্য করলো না গাড়িটা। জাওয়াদও পাল্লা দিয়ে গতি বাড়িয়ে দিলো তার বাইকের। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গাড়িটার প্রায় পেছনে চলে এলো তারা। ছফা পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করার ভঙ্গি করলো সতর্কতার অংশ হিসেবে, যাতে ড্রাইভার সাইডমিরর দিয়ে দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়।
কিন্তু গাড়িটা যে চালাচ্ছে সে অনেক বেশি মরিয়া। গতি আরো বাড়িয়ে দিলো সে। পেছনে তাকিয়ে ছফা দেখতে পেলো, ব্যাকআপ টিমের জিপ আর ভ্যানটা তাদের পিছু পিছু আসছে।
“তুমি গাড়িটার ডানদিকে থাকো!” চিৎকার করে বললো ছফা।
জাওয়াদ তাই করলো, গতি বাড়িয়ে প্রাইভেটকারটার ডানদিকের ড্রাইভিং ডোরের সমান্তরালে নিয়ে এলো তার বাইকটা। ইনসাইড লাইট বন্ধ থাকার কারনে ঘন কালো কাঁচের ভেতর দিয়ে ছফা দেখতে পেলো না গাড়িতে যাত্রি হিসেবে কে আছে, কে চালাচ্ছে ওটা। তবে সে নিশ্চিত, মুশকান জুবেরি বসে আছে সেখানে। সঙ্গে হয়তো সুস্মিতাও!
ছফা যে বাড়িগুলো তল্লাশি করবে সেটা সম্ভবত দেখে ফেলেছে জানালা দিয়ে, বুঝে গেছে বাড়িতে থাকলে নির্ঘাত ধরা পড়ে যাবে, তাই ঝুঁকি নিয়ে হলেও গাড়িতে করে পালানোর চেষ্টা করেছে।