যাই হোক, সব কিছু সামাল দেবার পরই ডাক্তারকে মুশকান জানিয়েছিলো, নির্জন বাড়িতে একা পেয়ে সুস্মিতার এক ছেলেবন্ধু তাকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিলো, মেয়েটা বাধা দেবার চেষ্টা করলে ঘটনাচক্রে ঐ ছেলে মারা যায়। সব শুনে হতভম্ব হয়ে পড়েন ডাক্তার। মুশকান আরো জানায়, সুস্মিতাকে বাঁচানোর জন্য যা করার তা-ই করেছে। এখন দ্রুত এ বাড়ির দারোয়ানকে বদলে ফেলতে হবে আগাম সতর্কতার অংশ হিসেবে, কারণ সুকুমার যে এ বাসায় এসেছিলো সেটা দারোয়ান দেখেছে। মুশকান। জানতো, পুলিশ খুব শিগগিরই জেনে যাবে সুকুমারের বন্ধু ছিলো সুস্মিতা। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বাড়িতে চলে আসবে হয়তো। তখন সুস্মিতা অস্বীকার করে বলবে, ঐদিন সুকুমার এ বাড়িতে আসেনি। কিন্তু এখনকার দারোয়ান থাকলে সমস্যা। পুলিশ তার কাছ থেকে এটা জেনে যাবে। এ ঝুঁকি নেয়া যায় না।
মুশকানের কথাটা বুঝতে পারেন আসকার। শুভমিতার বড়বোন পারমিতা মারা গেলে সমাদ্দার ভিলার দেখাশোনা করতো সুস্মিতার মায়ের দূরসম্পর্কের এক কাজিন, ভদ্রলোক থাকে বারাসাতে। তার মাধ্যমেই নতুন একজন দারোয়ান নিয়োগ দেন ডাক্তার।
মুশকানের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে একদিন সমাদ্দার ভিলায় হাজির হয় পুলিশ। সুকুমার রঞ্জনের নিখোঁজ কেসে সুস্মিতাকে জেরা করে তদন্তকারী অফিসার। সুস্মিতা জোর দিয়ে বলে, সুকুমারের সাথে ওইদিন তার দেখা হয়নি। সে কেন সল্টলেকে এসেছিলো তা-ও জানে না। তারপরও পুলিশ তাকে বলে দেয়, কলকাতার বাইরে গেলে সে যেনো লোকাল থানায় অবশ্যই ইনফর্ম করে।
পুলিশ বাড়ি থেকে বের হবার পর তিন তলায় নিজের ঘরের জানালা দিয়ে মুশকান দেখে, তাদের বাড়ির দারোয়ানের সাথে সাথে কথা বলার পর আশেপাশের বাড়িগুলোর দারোয়ানদের সাথেও কথা বলছে ঐ তদন্তকারী অফিসার। পুলিশ চলে যেতেই মুশকান ঐ দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়, ইন্সপেক্টর কী জানতে চেয়েছিলো তার কাছে।
সমাদ্দার ভিলার আগের দারোয়ানের নাম-ঠিকানা? আর লোকটা সেই তথ্য দিয়েও দিয়েছে!
সতর্ক হয়ে ওঠে মুশকান। সুকুমারের কেসে যে সুস্মিতা ফেঁসে যাবে বুঝতে পারে, আর সেটা হলে প্রকারান্তরে সে নিজেও ফেঁসে যাবে-লাশটা তো সে-ই গুম করেছে!
আসকারকে ফোন করে সব জানায় সে। ডাক্তার তাদের সাময়িক আশ্রয়ের একটি ঠিকানা দিয়ে দিলে তড়িঘড়ি দরকারি সব জিনিসপত্র নিয়ে সুস্মিতা আর সে বাড়ি ছাড়ে ঐ দিনই।
সন্ধ্যার দিকে আবারো বাড়িতে পুলিশ আসে। এবার ঐ অফিসারের হাতে শক্ত প্রমাণ আছে-সুস্মিতা পুলিশকে মিথ্যে বলেছে। সুকুমার রঞ্জন নিখোঁজ হবার আগে শেষ যে জায়গায় গেছিলো সেটা সল্টলেকের সমাদ্দার ভিলা! কিন্তু ততোক্ষণে বাড়ির বাসিন্দারা কোথায় চলে গেছে দারোয়ানও জানাতে পারেনি।
এ ঘটনার পর দিনই আসকার ঢাকা থেকে চলে আসেন কলকাতায়, পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে, টাকার বিনিময়ে মুশকান আর সুস্মিতাকে বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি।
মুশকান যেহেতু ঢাকা শহরে নিরাপদ নয়, ছফার চোখে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে, তাই তাকে অন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিয়ে, সুস্মিতাকে ঢাকার বনানীর বাড়িতে তোলেন তিনি। এই বাড়িটা আর কারোর নয়, রাশেদ জুবেরির পৈতৃক বাড়ি। রাশেদের মৃত্যুর পর মুশকানের সম্পত্তি হয়ে ওঠে বাড়িটা। ওখানে কিছু দিন থাকার পরই হাপিয়ে ওঠে সুস্মিতা। এরকমই এক সময়ে সুন্দরপুরের নতুন স্কুল পরিদর্শন করতে গেলে মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে যান আসকার। তখন ট্রাস্টি রমাকান্তকামার কথায় কথায় জানান, সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্কুলের জন্য একজন গানের টিচার খুঁজছেন। এ কথা শোনার পর ডাক্তারের মাথায় আসে নিজের মেয়ের কথা। প্রস্তাবটা পেয়ে লুফে নেয় সুস্মিতা। প্রকৃতি তার কাছে সব সময়ই ভালো লাগে, আর সুন্দরপুর স্কুলটাও তার কাছে ছিলো এক টুকরো শান্তিনিকেতনের মতোই।
.
অধ্যায় ৯৮
অভিজাত এলাকা বারিধারায় এসে নুরে ছফা আকাশের দিকে তাকালো। বৃষ্টি শেষে সব মেঘ উধাও হয়ে গেছে, এখন বিশাল ফাঁকা শূন্যতা মাথার উপরে। শহরের উপর দিয়ে বইছে ঠাণ্ডা বাতাস। তার শরীরে লেপ্টে আছে ভেজা জামা-কাপড়।
বিগত দেড়-ঘণ্টা ধরে সে আর তার সহকারী জাওয়াদ ভীষণ ব্যস্ত। পিএসের বাড়ির সিসিক্যাম ফুটেজ দেখা থেকে শুরু করে তাদের অনুসন্ধান, সেখানে মুশকান জুবেরির ফুটেজ পেয়েছে। আরো দেখেছে, বাড়ি থেকে বের হবার পর মহিলা কোথায় গেছে সেটাও। তবে পিএস, কেএস খান আর আসলামের ফোন নাম্বারগুলো পুলিশের টেলিকমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টে ট্র্যাক করার জন্য দিলে তারা জানায়, সবগুলো ফোনই বন্ধ আছে এখন।
উদ্বিগ্ন ছফা কেএস খানের ল্যান্ডফোনে কল দিয়ে জেনে নিয়েছে, আইনস্টাইন পুরোপুরি সুস্থ আছে। মি. খান জানতে চেয়েছিলো, এখন কী অবস্থা, ছফা তাকে বলেছে, এ মুহূর্তে সে ব্যস্ত আছে মুশকানকে ধরার কাজে, পরে তাকে সব জানাবে।
যাই হোক, পিএসের অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান যেরকমটি বলেছে, মুশকান কিছুটা পথ হেঁটে সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকারে গিয়ে ওঠে। এটা তারা দেখেছে রাস্তায় বসানো ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের সিসিক্যামগুলো থেকে। পিএসকে দিয়ে ছফা তাদেরকে অনুরোধ করেছে, এই ট্র্যাক ডাউনের কাজে যেনো তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা হয়।