কিছুক্ষণ পরই টের পায়, উপগত হওয়া সুকুমার নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। প্রায় অসাড়! হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। কিন্তু যখন বুঝতে পারে, ছেলেটা একদমই নড়ছে না তখন ভড়কে যায়। মুশকান যে একজন মেডিকেল ডাক্তার এতো দিনে সেটা জেনে গেছিলো। সম্ভবত এতোক্ষণে বাড়িতে ফিরেও এসেছে। ব্রা আর পেন্টি পরা অবস্থায়ই দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে তিন তলায় চলে যায় সে, দেখতে পায় মুশকান সবেমাত্র ঘরে ফিরে এসে ফ্রিজ খুলে সজি আর ফলমূল রাখছে। সুস্মিতাকে এরকম অবস্থায় দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয় সে। সুস্মিতা হরবর করে তাকে জানায় কী হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে দোতলায় নেমে আসে মুশকান, সুকুমারের পাস চেক করে দেখে সে, কিন্তু ততোক্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে ছেলেটি।
মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে শুরু করে মুশকান। পুলিশকে খবর দিলে, তারা জেনে গেলে কী হতে পারে সেটা তার চেয়ে ভালো আর কেউ জানতো না। সুস্মিতা যদি সব কিছু স্বীকারও করে, আইনের কাছে নিজেকে পুরোপুরি নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে, কারণ আত্মরক্ষার জন্যে কাউকে আঘাত করা যেতে পারে, রাগের মাথায় হুট করে মেরে বসাও স্বাভাবিক, কিন্তু সুকুমারের মাথা যেভাবে থেতলে গেছে, সেটা স্পষ্ট বলে দেবে, সুস্মিতা কেবল আত্মরক্ষার জন্যে আঘাত করেনি! তার উদ্দেশ্য ছিলো হত্যা করা! যদিও ভালো একজন আইনজীবী নিয়োগ দিলে সে হয়তো যুক্তিতর্ক দিয়ে আদালতকে বোঝাতে পারবে, ওরকম মুহূর্তে মারাত্মক ‘প্যানিল্ড’ হয়ে সাময়িক হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো মেয়েটি। আদতে যে সেরকমই কিছু হয়েছিলো, তাতে অবশ্য মুশকানের কোনো সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু পুলিশের কাছে সব খুলে বললেও মেয়েটি মামলা মোকদ্দমার হয়রানি থেকে বাঁচতে পারবে না। সামাজিকভাবে খুনি হিসেবে তকমা পাওয়া থেকেও রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠবে। তার চেয়েও বড় কথা, সুস্মিতার কাছ থেকে যখন জানতে পারে, সুকুমারের বাবা একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, তখন মুশকান বুঝে যায়, আইনের মারপ্যাঁচে ফেলে, অপব্যবহার করে মেয়েটার জীবন বিষিয়ে তুলবে ঐ লোক। নিজের সন্তান যে ধর্ষক না সেটা প্রমাণ করার জন্য যা করার তাই করবে।
এদিকে বাড়িতে তার উপস্থিতিও একটা সমস্যা। পুলিশ তার ব্যাপারেও জানতে চাইবে, খোঁজ নেবে। আর সেরকম কিছু কী হতে পারে, ভালো করেই জানতো মুশকান। সে যে অবৈধভাবে কলকাতায় এসেছে, মিথ্যে পরিচয় নিয়ে বাস করছে, এসব জেনে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। এরকম ঝুঁকি সে-ও নিতে পারে না।
সুস্মিতার বাবা আসকারের সাথে আর যোগাযোগ করেনি মুশকান। ভালো করেই জানতো, দূর থেকে বেচারা না পারবে কোনো বুদ্ধি দিতে, না পারবে কোনো সাহায্য করতে। তাই মুশকান সিদ্ধান্ত নেয়, বন্ধুর মেয়েকে বাঁচাতে হবে। যে বন্ধু তাকে বিপদে আপদে বার বার রক্ষা করেছে, সাহায্য করেছে, তার মেয়েকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতেই হবে।
সুস্মিতাকে আশ্বস্ত করে সে-চিন্তার কিছু নেই। সব কিছু সামলে নেবে সে। এর পর সুকুমারের নিথর দেহটা দু-জনে মিলে ধরাধরি করে তিন তলায় নিয়ে যায়। ডিপি মল্লিককে যেভাবে উধাও করেছিলো ঠিক একই কায়দায় সুকুমারকেও উধাও করে মুশকান।
এই ঘটনার কয়েক দিন পর, এক বিকেলে কী একটা দরকারে বাইরে গেছিলো মুশকান, কিন্তু অনেকটা পথ যাবার পর বুঝতে পারে টাকা রাখার পার্সটা ফেলে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে ফিরে আসে সে। আর তখনই একটি দৃশ্য দেখে ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে ওঠে : তার ঘরে বইয়ের শেফের পেছনে লুকিয়ে রাখা সেই বয়ামটার মুখ খুলছে সুস্মিতা!
হাতেনাতে ধরা পড়ার পর মেয়েটা ঘাবড়ে না গিয়ে বরং মুশকানকেই ভড়কে দেয়।
“আমিও তোমার মতো হতে চাই!”
কয়েক মুহূর্তের জন্য মুশকান কথাটার মানে বুঝতে পারেনি।
“দীর্ঘ যৌবন পেতে চাই!”
ভুরু কুঁচকে যায় তার। বিস্ময়ে, অবিশ্বাসে!
“আমি তোমার সব কথা জানি!”
তারপরই সুস্মিতা তাকে অভয় দিয়ে বলতে শুরু করে-একেবারে আন্দিজের ঘটনা থেকে শুরু করে সার্জনকে গুম করা, তার বাপাইর সাথে রহস্যময় খাবার খাওয়া, তাদের অদ্ভুত সেই কথোপকথন, সর্বোপরি দীর্ঘ দিন ধরে মুশকান যে নিজের যৌবন ধরে রেখেছে-সব। থ বনে যায় মুশকান। সুস্মিতার জায়গায় অন্য কেউ হলে তাকে হয়তো ডিপি মল্লিকের মতোই কিছু করতো, কিন্তু এই মেয়ে তার সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর একমাত্র সন্তান!
পরিহাসের হাসি ফুটে উঠেছিলো হয়তো তার ঠোঁটে। সুস্মিতার মা শুভমিতা ছিলো তার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু এক সময় সতর্কতার কারণেই নিজেকে সেই বন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলো সে, চলে গেছিলো ইউরোপের অন্য একটি দেশে, সেখান থেকে নিজদেশে। কোনো রকম যোগাযোগ রাখেনি সে। আসকার তার স্ত্রীকে বলেছিলো, মুশকান কোনো এক বিদেশিকে বিয়ে করে কোথায় চলে গেছে সে নিজেও জানে না। মুশকান যদি এভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে না নিতো তাহলে শুভমিতাও টের পেয়ে যেতো তার বয়স বাড়ছে না! নিয়তির নির্মম পরিহাস, এখন সেই শুভমিতার মেয়েই কিনা জেনে গেলে সেটা!
কয়েক মুহূর্তের জন্য ভীষণ অসহায় বোধ করে সে। বুঝতে পারে, এখন সুস্মিতাকে না পারবে ভুলভাল ব্যাখ্যা দিতে, না পারবে তার মুখ বন্ধ রাখতে-তার কাছে কেবল একটাই পথ খোলা আছে: মেয়েটাকে নিজেদের দলে নিয়ে নেয়া-এতোদিন যে দলটির সদস্য ছিলো মাত্র দু-জন : সে আর আসকার।