“হুম।” খেতে খেতে বলেন ডাক্তার।
“সার্জনেরটা ঘটনাচক্রে পেয়ে গেছি, নইলে এখানে কিছু করার কথা ভাবিনি।”
মাথা নেড়ে সায় দেন আসকার। “তোমার পাসপোর্টটা করা লাগবে দ্রুত। আমি একজনের সঙ্গে কথা বলেছি, ও বলেছে করে দিতে পারবে।”
প্রসঙ্গ পাল্টায় মুশকান। “আচ্ছা, তোমার মেয়ে হুট করে চলে এলো কেন? কিছু হয়েছে নাকি?”
ঠোঁট ওল্টান আসকার। “ও তো কিছু বলেনি।” একটু থেমে আবার বলেন, “ও ওর মায়ের মতোই একটু খেয়ালি স্বভাবের হয়েছে। যখন যা ইচ্ছে তা-ই করে।”
“আমাদেরকে নিয়ে সন্দেহ করছে না তো?”
অবাক হন ডাক্তার। “কীসের সন্দেহ করবে? আমি স্যুয়োর্ধ্ব এক বৃদ্ধ, আর তুমি আমার মেয়ের বয়সী,” বলেই হেসে ফেলেন। “ও জানে তুমি আমার বন্ধুর মেয়ে, সন্দেহ করার প্রশ্নই ওঠে না।”
“তুমি ধরেই নিয়েছো, তুমি যা বলেছে ও সেটা বিশ্বাস করে নেবে?”
“নিতে হবে, কারণ তোমার সাথে আমার ওরকম কোনো সম্পর্ক নেই।”
“কিন্তু ও সেটা না-ও বুঝতে পারে?”
“ওর কথা বাদ দাও। ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না। দেখবে, কিছু দিন পরই লন্ডনে ফিরে গেছে। ও খুব অস্থির…দ্রুত বোরিং হয়ে যায়।”
মুশকান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জানতে চায়, “আচ্ছা, তুমি তো প্রায় পাঁচ বছর ধরে খাচ্ছো, কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করছো কি?”
“না,” কথাটা বলেই মুচকি হাসি দেন ডাক্তার। “কোনো পরিবর্তনই লক্ষ্য করছি না!”
মুশকানও হেসে ফেলে। “তাহলে তো তোমার বেলায়ও কাজ করতে শুরু করেছে!”
রেডওয়াইনের গ্লাসটা তুলে নেন ডাক্তার। “থ্যাঙ্কস ইউ, ফ্রেন্ড।” একটু থেমে তার বাপাই আবার বলে, “আমার নার্ভও আগের চেয়ে স্ট্রং হয়েছে।”
আশ্বস্ত করার হাসি দিয়েছিলো মুশকান।
বাবা আর ঐ রহস্যময়ী নারীর কথাবার্তা শুনে সুস্মিতার পা দুটো টলে গেছিলো, আরেকটুর জন্যে চেয়ারের উপরে রাখা কাহন থেকে পড়েই যেতো সে।
ওদের আরো কিছু কথাবার্তা থেকে যা বুঝতে পারে-ঐ মহিলা একজন সার্জনকে কিছু করেছে, আর সেটা তাকে ব্ল্যাকমেইল করার শাস্তি হিসেবে। কিন্তু লোকটাকে কী করেছে না জানলেও, এটা বুঝতে বাকি নেই, সে আর এই জগতে বিচরণ করছে না! তার চেয়েও বড় কথা, অজ্ঞাত একটি রেসিপি খেয়ে নিজের যৌবন ধরে রেখেছে, মহিলা আসলে তার বাবার বয়সী প্রায়! আর তার বাপাইও পাঁচ বছর ধরে এই রেসিপিটা খাচ্ছে। কিন্তু বয়স ধরে রাখার এই গোপন কৌশলটা কী সেটা আন্দাজ করতে গিয়ে সুস্মিতা ধন্দে পড়ে যায়। ওদের কিছু কথা ঘুরপাক খেতে থাকে তার মাথায় :
সার্জনেরটা? সার্জনেরটা দিয়ে কতদিন চলবে?
গা শিউরে ওঠে তার। দুর্নিবার কৌতূহলে আক্রান্ত হয় সে। সত্ত্বর বছরের এক নারী! অথচ দেখলে মনে হবে প্রায় তার বয়সী কেউ!
কয়েক দিন পর তার বাপাই আবার কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে যান। এর পর সুস্মিতা অন্য একটি কৌশল বেছে নেয় : মুশকানের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে শুরু করে সে। দেখতে তারা প্রায় সমবয়সী, একই বাড়িতে থাকে, সুতরাং ঘনিষ্ঠতা হতে সময় লাগেনি। একসাথে তারা কলকাতা এবং এর আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। তাদের অখণ্ড অবসরে কেনাকাটা, বাজার করা, সিনেমা-থিয়েটার দেখা, এসব হয়ে ওঠে নিয়মিত কাজ। বাড়িতে সুস্মিতার বন্ধুদের আড্ডা বসলে সেখানে মুশকানও যোগ দিতে শুরু করে। সুস্মিতা তাকে তার কাজিন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় বন্ধুদের কাছে।
বেশ ভালো গান করে সুস্মিতা, কিছু বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে পারে। তার ঘরে সেতার, হারমোনিয়ামসহ কিছু ইট্রুমেন্ট আছে। সে অবাক হয়ে দেখে, তার মতোই রবীন্দ্রনাথের বিরাট ভক্ত মুশকান, আর গানও গায় চমৎকার। রাতে, ডিনারের পর তারা দুজন একের পর এক গান করে সময় কাটিয়ে দিতে। খুব দ্রুতই মুশকানের মধ্য আরেকটি গুণ আবিষ্কার করে সুস্মিতা-তার হাতের রান্না অসাধারণ!
সুস্মিতা দীর্ঘদিন লন্ডনে থেকেছে, ইউরোপ-আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে গেছে, নানা রকম খাবারের সাথে সে পরিচিত, ভারতীয় খাবারও কম চেখে দেখেনি, কিন্তু মুশকানের হাতে এক একটি পদ যেনো অমৃত। তাদের বাসায় এক মহিলা কুক এসে রান্না করে দিয়ে যেতো, কিন্তু সেসব খাবার খুব একটা ভালো লাগতো না সুস্মিতার। মুশকানের জাদুকরী হাতের রান্নার স্বাদ পাবার পর থেকে তার খাওয়ার রুচি বেড়ে যায়।
একদিন কী একটা কাজে মুশকান বাইরে গেলে সুস্মিতা হানা দেয় তিন তলায়। আগেই মুশকানের ঘরের চাবির ছাপ নিয়ে রেখেছিলো সাবানের টুকরোর উপরে, সেটা থেকে নকল একটা চাবিও বানিয়ে নিয়েছিলো। ঐ চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করে সে, কিন্তু রহস্যময় সেই খাবারটি আর পায় না। অবশেষে বইয়ের সেফের দিকে নজর যায় তার। মুশকানের ঘরে প্রচুর বইপুস্তক। বুকসেলফের প্রতিটি বই সরিয়ে সরিয়ে দেখে সুস্মিতা। অবশেষে রবীন্দ্রনাথের কাব্যসমগ্রের পেছনে দেখতে পায় সেই বয়ামটি-তার বাপাইকে যেখান থেকে রহস্যময় খাবার তুলে দিয়েছিলো মুশকান। বয়ামটা খুলে দেখে, অনেকটা আচারের মতো সামান্য। কিছু বস্তু আছে তখনও, তবে সে জানতো, ওগুলো আচার নয়। খাবারটা দেখে তার মধ্যে এক ধরণের ভীতি জেগে ওঠার কথা, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যৌবন দীর্ঘায়িত করার তীব্র আকাঙ্খর কাছে সেই ভীতি পরাভূত হয়। ঐ রহস্যময় বস্তুটার এক টুকরো মুখে দিতেই বুঝতে পারে, মুশকানের জাদুকরী হাতের ছোঁয়া এখানেও বজায় রয়েছে।