তার বাপাই বলেছিলো, ঐ গেস্টের নাম তামান্না রহমান, কিন্তু আসকার তাকে মুশকান বলে সম্বোধন করছিলেন! একজন প্লাস্টিক সার্জনকে নিয়েও কথা বলছিলো তারা। সবটা শুনতে না পেলেও, যেটুকু বুঝেছে, ঐ লোক মুশকান নামের মহিলাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছিলো।
বাপাই কেন মহিলার নামটা মিথ্যে বলেছে? আর কীসের জন্য তাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে ঐ সার্জন?-সবটা তার কাছে পরিস্কার ছিলো না, সে কারণেই মুশকানের ব্যাপারে প্রচণ্ড কৌতূহলি হয়ে ওঠে সুস্মিতা। আরেকটা ব্যাপার তার মনে খটকার সৃষ্টি করে : তার মায়ের বহু পুরনো ছবির অ্যালবামে মুশকানের মতো একজনকে সে দেখেছে অনেক দিন আগে! মায়ের মৃত্যুর পর স্মৃতি সংরক্ষণের সমস্ত প্রিন্টেড ছবিগুলোর ডিজিটাইজ করে ফেলেছিলো লন্ডনে থাকতেই, সেগুলো ফটো অ্যালবাম বানিয়ে স্টোর করে রেখেছিলো তার ল্যাপটপে।
ঐদিনই ফটো অ্যালবামটি ঘাঁটতে শুরু করে দেয় সে। অনেক ছবি, অনেক স্মৃতি। কিছুক্ষণ পরই সুস্মিতা আবিষ্কার করে, তার বাবা-মায়ের, দু জনেরই কমনফ্রেন্ড হলো এই মুশকান! মুশকান সোহেলি! বেশ কয়েকটি ছবির পেছনে তার মা নিজেদের নামের সাথে ওই নামটাও লিখে রেখেছিলো। কিন্তু সেই ছবিগুলো সুস্মিতার জন্মেরও আগে, প্রায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো! এতগুলো বছরে মহিলার মধ্যে কোনো পরিবর্তনই হয়নি!
সুস্মিতা জানে না কততক্ষণ সে হতভম্ব হয়ে বসেছিলো। এটা কী করে সম্ভব! কিভাবে ঐ মহিলা এতোগুলো বছরেও একই রকম আছে? আড়াল থেকে শোনা তার বাপাই আর মুশকানের কথাবার্তার অনেক কিছুই বোধগম্য ছিলো না, ছবির অ্যালবাম দেখার পর সেগুলো আরো দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। সুস্মিতার মনে পড়ে যায়, এক পর্যায়ে রহস্যময়ী ঐ মহিলা তার বাবাকে বলেছিলো, পরশু ডিনারের আয়োজন করবে। কথাটা শুনে তার বাপাইর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারচেয়েও বড় কথা, মহিলার বলা ‘ডিনার শব্দটির উল্লেখও কেমন ইঙ্গিতপূর্ণ ছিলো!
এর পরই সুস্মিতা চালাকি করে বাবাকে বলে, আগামীকাল মুকুন্দপুরে এক বন্ধুর বাসায় ডিনারের দাওয়াত আছে, ফিরতে একটু রাত হবে। কথাটা শুনে তার বাপাই খুশিই হয়েছিলো বলেই তার ধারণা। কিন্তু পরদিন সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেও রাত সাড়ে আটটার আগেই ফিরে আসে। বাপাইকে ঘরে দেখতে না পেয়ে চুপিসারে উঠে যায় তিন তলায়।
তাদের বাড়ির তিন তলার কেবলমাত্র একটি অংশে বড় একটা ঘর তুলেছিলো তার পারমিতা মাসি। সিঁড়ির ডান পাশে, ছাদের বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ঔষুধি গাছের বাগানও করেছিলো। মাসি মারা যাবার পর থেকে সেটার আর যত্ন নেয়া হয়নি। তবে সে দেখতে পায়, মুশকান তাদের বাড়িতে ওঠার পর বেশ যত্ন নিয়েছে বাগানটার।
বাগানের উত্তরে, সিঁড়ি ঘরের পেছন দিকে সরু একটা প্যাসেজ চলে গেছে, ওটা থেমেছে ছাদের পুবদিকে একমাত্র ঘরটির পশ্চিম দিকের দেয়ালে গিয়ে। দেয়ালের একেবারে উপরে ছোট্ট একটি ভেন্ট্রিলেটর আছে, বাগানে থাকা একটা চেয়ার ব্যবহার করেও পাঁচ ফিট চার ইঞ্চির সুস্মিতার পক্ষে সেই ভেন্ট্রিলেটরে চোখ রাখা সম্ভব হয়নি। দ্রুত নীচতলায় চলে যায় সে, চেয়ারের মতো কিছু না পেয়ে আফ্রিকান বাদ্যযন্ত্র কাহনটা চোখে পড়ে তার। গানবাজনার প্রয়োজনে শখ করে কিনেছিলো ওটা। চেয়ারের উপর বাক্স সদৃশ কাহনটা রেখে তার উপরে দাঁড়ানোর পর ভেন্ট্রিলেটর দিয়ে ঘরের ভেতরের দৃশ্যটা দেখতে পায় সুস্মিতা।
তার বাপাই আর মুশকান সোহেলি নামের ঐ মহিলা ডিনার করছে। তাদের মধ্যে খুব কমই কথা হচ্ছিলো তখন। ডিনারের শেষে মুশকান বিশেষ একটি বাটি হাতে নিয়ে রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকায় আসকার ইবনে সায়িদের দিকে। সুস্মিতা দেখতে পায়, তার বাপাইর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বাটির খাবারটা যে মাংসজাতীয় কিছু সেটা বুঝতে পেরেছিলো দূর থেকেও। সেই রান্না করা মাংসের অনেকটুকু অংশ তার বাপাইর পাতে তুলে দেয় মহিলা, তারপর রেড ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে চিয়ার্স করে।
এ সময় সুস্মিতাকে অবাক করে দিয়ে তার বাপাই বলে ওঠে : “সার্জনেরটা?”
মুশকান শুধু মাথা নেড়ে সায় দেয়।
সার্জনেরটা মানে?? এ প্রশ্ন যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তখনই তার বাবার আরো কিছু কথা তাকে আগ্রহী করে তোলে।
“তাহলে তোমার সার্জারির ব্যাপারটা কী করবে?”
“সেটা কি এখানে করা সম্ভব?”
ডাক্তার আসকার একটু ভেবে নেন। “সাউথ কোরিয়াতে খুব সহজেই করা যাবে। ওখানে এসব কাজ প্রচুর হয়…ভালো সার্জনও আছে অনেক।”
“এখান থেকে কিভাবে যাবো? আমার পাসপোর্ট দিয়ে তো এখানে আসিনি। দেশে গিয়ে ওটা ইউজ করাও যাবে না…খুবই রিস্কি।”
“এখানকার পাসপোর্ট করা যাবে, কিন্তু সময় লাগবে একটু। ততোদিন–হয় অপেক্ষা করো?”
“হুম।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ দু-জনেই খেয়ে যায় ঐ রহস্যময় খাবারটি।
“সার্জনেরটা দিয়ে কতোদিন চলবে?” খাবারের বাটিটার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন ডাক্তার।
ঠোঁট ওল্টায় মুশকান। “দু-জনের জন্য দুবারের বেশি হবে না।”
কথাটা শুনে ডাক্তারের চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে। “তাহলে এর পর কী করবে?”
মুশকান কোনো জবাব না দিয়ে মুখে খাবার নিয়ে ভেবে যায় কিছুক্ষণ। “চিন্তা কোরো না…একটা ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু এখানে আর কিছু করা ঠিক হবে না। শহর এলাকা…বুঝতেই পারছো।”