ডিপি মল্লিক কোনো রকম কালক্ষেপন না করেই শর্তগুলো মেনে নেয়। তবে সে-ও পাল্টা একটি শর্ত দিয়ে বসে : মুশকানের সান্নিধ্য পাবার সাথে সাথে তার হাতের জাদুকরি রান্নার আস্বাদনও নিতে চায়।
তিন দিন পর এক সন্ধ্যায় সল্টলেকের বাড়িতে হাজির হয় সার্জন। মুশকান প্রথমেই ডিপি মল্লিকের কাছে জানতে চায়, এখানে আসার কথাটা সে গোপন রেখেছে কিনা। মল্লিক তাকে আশ্বস্ত করে, এ কথা কেউই জানে না। আলাপচারিতা শুরুর এক পর্যায়ে ডিপি মল্লিক জানায়, কয়েক বছর আগে মুশকানকে সে স্বল্প সময়ের জন্য দেখেছিলো তার রেস্টুরেন্টে, ডাক্তার আসকার তাকে পরিচয় করে দিয়েছিলেন তখন। সেই থেকেই নাকি তার প্রতি তীব্র কৌতূহল আর আকর্ষণ বোধ করছিলো। মুশকান স্মিত হেসেছিলো কেবল। সত্যি বলতে, ডাক্তারের সাথে তার পরিচয়পর্বের কথা মনে নেই। রবীন্দ্রনাথে প্রায়শই এরকম গেস্ট আসতো, সবার কথা মনে রাখা সম্ভব নয়।
সন্ধ্যা একটু গাঢ় হলে সার্জনকে খাবারের টেবিলে আমন্ত্রণ জানায় সে, তার জাদুকরি রান্নার স্বাদ গ্রহণ করে ডিপি মল্লিক। কিন্তু খাবারের চেয়েও তার কাছে লোভনীয় ছিলো মুশকানের সান্নিধ্য! ডিনার শেষে রেড ওয়াইনের বোতলের ছিপি খোলে মুশকান। লালচে মদের মাদকতায় আচ্ছন্ন ডিপি মল্লিকের লালসা প্রকট হয়। অস্থির হয়ে মুশকানকে জাপটে ধরে ফেলে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে বলে-এভাবে না। রুচিশীল মানুষের মতো যেনো আচরণ করে। ধীরে ধীরে, মার্জিতভাবে!
ডিপি মল্লিক নিজের এমন ছেলেমানুষি আচরণের জন্য লজ্জিত বোধ করে। মুশকান যেভাবে চায় সেভাবেই হবে-ধীরে ধীরে! কিন্তু রাত গাঢ় হবার আগেই সার্জন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এক সময় পুরোপুরি নিথর।
রেড ওয়াইনে কোনো বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশায়নি মুশকান। বাড়ির ছাদে যে ঔষধি বাগানটা আছে, সেখানে একটি টবে প্রাণঘাতী বিষাক্ত অরিয়েন্ডার ছিলো, সেটার ফুল খুবই বিষধর, মল্লিকের গ্লাসে সেই ফুলের রস মিশিয়ে রেখেছিলো। ধীরে ধীরে ওটা সমস্ত শরীর অবশ করে দেয়। মল্লিকের ফোনটা চেক করে দেখে সে। তার ফেসবুকে ঢোকাটা যে এতো সহজ হবে কল্পনাও করতে পারেনি-সার্জন ফেসবুক থেকে লগ অফ করার ধার ধারতো না। মল্লিকের আইডিটা ডিলিট করে দেয়, নষ্ট করে ফেলে ফোন আর সিমটা। পাল্স চেক করে দেখে সার্জন তখনও বেঁচে আছে। নিস্তেজ মল্লিকের ঘাড়টা মটকে দিতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি।
ডিপি মল্লিককে অপচয় করার মতো বোকামি করেনি সে। সার্জনের বয়স, সুস্বাস্থ্য, সব কিছুই তার শিকার হবার জন্য উপযুক্ত ছিলো। তাই প্রয়োজনীয় প্রত্যঙ্গটি রেখে মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে একটি প্লাস্টিকের ড্রামে রেখে দেয়। আগের দিনই এরকম একটি খালি কেমিক্যালের ড্রাম আর কয়েক কেজি চুন কিনে এনেছিলো দারোয়ানকে দিয়ে, বলেছিলো ছাদের বাগানে পানি সংরক্ষণ করবে, চুনগুলো ব্যবহার করবে সার হিসেবে।
চুন আর পানি মিশিয়ে ডিপি মল্লিকের দেহের খণ্ডিত অংশগুলো ড্রামে রেখে দেয়। তিন তলার অ্যাটাচড বাথরুমে সেই ড্রামটি এক মাসের মতো রাখা ছিলো। সে জানতো, মাসখানেক পর ড্রাম খুললে দেখতে পাবে চুনের সাথে গলেটলে সব একাকার হয়ে গেছে-ঘন তরল ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। আর ঠিক সেটাই হয়েছিলো। মুশকান সেই ঘন আর ভারি তরল বাথরুমের কমোডে ঢেলে ফ্ল্যাশ করে দেয়, পৃথিবীর বুক থেকে উধাও হয়ে যায় দয়াল প্রসাদ মল্লিক!
বাড়ির দারোয়ান যাতে কিছু বুঝতে না পারে সেজন্যে সামান্য একটু চালাকি করেছিলো মুশকান। সার্জনকে ঘায়েল করার পর রাতের এক পর্যায়ে দারোয়ানকে দরকারি একটা জিনিস কিনতে পাঠিয়ে দেয় সে। লোকটা ফিরে এলে জানায়, গেস্ট চলে গেছে, সে যেনো মেইনগেটটা তালা মেরে বন্ধ করে দেয় আজকের মতো।
ডিপি মল্লিকের অন্তর্ধানের খবরটি পত্রপত্রিকায় এসেছিলো, তারপর সংবাদপত্র জগতের নিয়ম মেনে ওটা খুব দ্রুতই উধাও হয়ে যায় অন্য কোনো খবরের ভীড়ে।
মল্লিকের অন্তর্ধানের প্রায় পাঁচ-ছয় মাস পর ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ যখন কলকাতায় এলেন মুশকান তাকে সব খুলে বলেছিলো। সব শুনে নিজেকেই দায়ী মনে করেন ডাক্তার-অনেক বছর আগে, মল্লিককে যে রবীন্দ্রনাথে নিয়ে গেছিলেন এটা তার মনেই ছিলো না। মুশকান অবশ্য তাকে প্রবোধ দিয়ে বলেছিলো, এখানে তার কোনো দোষ নেই। অনেক দিন আগের কথা, মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু এরপর দিন বিকেলেই, একেবারে বিনা নোটিশে সুদূর লন্ডন থেকে চলে আসে তার একমাত্র সন্তান সুস্মিতা। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনার পাট না চুকিয়েই লন্ডনে চলে গেছিলো সে। অস্থিরচিত্তের এই মেয়ে বুঝতে পারছিলো না কোথায় সেটেল করবে। এ নিয়ে ডাক্তারও খুব চিন্তায় ছিলেন। মেয়েকে তিনি জানিয়েছিলেন, তার এক বন্ধুর মেয়েকে কিছু দিন সল্টলেকের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। আমেরিকান প্রবাসী এই মেয়ে রবীন্দ্রনাথের উপরে গবেষণার কাজে কয়েকটা মাস কলকাতায় থাকবে।
সুস্মিতা জানতো না তার বাবাও এখন কলকাতায় আছে। বাড়িতে এসে দারোয়ানের কাছ থেকে এটা জানতে পেরে খুবই অবাক হয়েছিলো সে। কিন্তু তার বিস্ময় দ্রুত বদলে যায় সন্দেহে, যখন বাবাকে ঘরে দেখতে পায় না। অন্য কিছু সন্দেহ করে সে। কৌতূহল থেকে দোতলায় উঠে যায় চুপিসারে। তার বাপাই আর ঐ মহিলা গেস্টের কথা শুনে থমকে যায়। ডাক্তার কিংবা মুশকান কেউই অতোটা সতর্ক ছিলো না, ফলে তাদের বেশির ভাগ কথাই শুনে ফেলে সুস্মিতা। সব শুনে বিস্ময়ে থ বনে যায় সে। বাপাই আর ঐ গেস্ট টের পাবার আগেই নিজের ঘরে ফিরে আসে দ্রুত। বলা বাহুল্য, তাকে দেখে ডাক্তার ভুত দেখার মতোই চমকে উঠেছিলেন। মেয়েকে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, জরুরী একটা কাজে কলকাতায় এসেছেন কয়েক দিনের জন্যে। সুস্মিতাও জানায়, হুট করেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শান্তিনিকেতনের কোর্সটা শেষ করবে এবার। ডাক্তার আর এ নিয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু সন্দেহ তৈরি হয়ে গেছিলে সুস্মিতার মধ্যে।