“ঐ ডাইনি আমেরিকা ছেড়ে চলে যাবার প্রায় বিশ বছর পর, বুবু আর দুলাভাই লন্ডনে গেছিলো কী একটা কাজে…হিথ্রো’তে তখন ঐ মুশকানকে নাকি বুবু দেখেছিলো!”
“বলেন কি!”
“তখনও মহিলার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখেনি বুবু…একদম অবিকল বিশ বছর আগে যেমন ছিলো তেমনি রয়ে গেছিলো!”
ছফার ভুরু কপালে উঠে গেলো।
“বুবু বলেছে, ঐ মহিলা তাকে দেখামাত্রই সটকে পড়ে। আমার দুলাভাইকে বুবু এ কথা বললে, তিনি মোটেও বিশ্বাস করেননি। দুলাভাইয়ের ধারণা, ওটা বুবুর হেলুসিনেশান ছিলো, নয়তো লোকজনের ভীড়ে মুশকানের মতো কাউকে দেখেছে।”
ছফা কী বলবে ভেবে পেলো না।
“বুবুও ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি কিছু ভাবেনি…বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলো, যা দেখেছে ভুলই দেখেছে, কিন্তু আমার কাছ থেকে সব শোনার পর বুবুর মনে হয়েছে, ঐদিন তার সেই দেখাটা মোটেও ভুল ছিলো না।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ডিবি অফিসার।
“যাই হোক, আপনি যে খুব একটা ভুল করেছেন তা-ও বলা যাবে না,” বললো আশেক মাহমুদ। “মহিলা সিরিয়াল কিলারদের মতোই…পার্থক্য হলো, সে তার শিকারদের নিছক খুন করে আনন্দ পায় না, তাদেরকে…” কথাটা আর শেষ করলো না, তার কোনো দরকারও নেই।
চুপ মেরে রইলো নুরে ছফা।
“এখন যেভাবে পারেন ওই ডাইনিকে খুঁজে বের করুন। যতো দ্রুত সম্ভব!” বললো আশেক মাহমুদ। “আমি চাই আমার বুবু যেনো জেনে যেতে পারে, তার সন্তানের হত্যাকারীকে ধরা হয়েছে। তার উপযুক্ত শাস্তি হবে।”
মুখ তুলে তাকালো ডিবির জাঁদরেল ইনভেস্টিগেটর। তিন বছরে যেটা করা সম্ভব হয়নি সেটা এই ছবি পাবার পর কি এতো দ্রুত করা যাবে?
“বুবুর জন্য খুব বেশি সময় নেই, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব। “আপনাকে যতো রকম সাহায্য সহযোগীতা করা দরকার করবো। সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করবো আমি। দরকার হলে ক্ষমতার বাইরে গিয়েও যা করার করবো!”
নুরে ছফা স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদের দিকে। পিএসের দৃঢ়তা সুস্পষ্ট। ব্যক্তিগত আবেগে ভাসছে।
“আপনি যা চাইবেন পাবেন। সব ধরণের সহযোগীতা,” একটু থেমে আবারো বললো, “সব কিছু মানে সব কিছু!
এটাকে আমি লাইসেন্স টু কিল’ হিসেবে ধরে নেবো কি? মনে মনে বলে উঠলো নুরে ছফা। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিবের ক্ষমতার পরিধি সম্পর্কে ভালোমতোই অবগত আছে সে। এরা চাইলে পারে না এমন কাজ নেই। পুলিশের বড় কর্তাদের বদলি থেকে শুরু করে টিভি স্টেশন ব্যাঙ্ক-বীমার লাইসেন্স পাইয়ে দেবার কাজও অনায়াসে করে দিতে পারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে প্রভাবিত করে কোনো মন্ত্রীর গদিও টলিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।
ছবিটার দিকে আবারো তাকালো ছফা। একটা মাত্র ছবি তাকে কতোটুকু সাহায্য করবে, জানে না। তবে এটা দিয়ে নতুন করে আবার শুরু করা যাবে-এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। “আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো, স্যার।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক মাহমুদ। “আপনি একটা সরকারী প্লটের জন্য আবেদন করুন, আমি বাকিটা দেখবো। আর প্রমোশন নিয়ে ভাববেন না। ধরে নিন, ওটা হয়ে গেছে।”
এরকম লোভনীয় প্রস্তাব শুনে ছফা বিব্রত বোধ করলেও অভিব্যক্তি লুকাতে পারলো। এ দেশে কাউকে ম্যানেজ করতে হলে তিনটি জিনিসই ব্যবহার করা হয়-পদ, পদক আর প্লট। ছফাকে পদোন্নতি আর প্লটের টোপ দেয়া হচ্ছে! পদকও হয়তো জুটে যাবে।
“স্যার, এসবের জন্য না,” অবশেষে বিনীতভাবেই বলার চেষ্টা করলো সে। “আমি এই কেসটা সল্ভ করার জন্যই মুশকান জুবেরিকে খুঁজে বের করবো। আমি চাই না আমার কোনো কেস আনসভ থাকুক।”
“দ্যাটস গুড,” বললো আশেক মাহমুদ। “খুঁজে বের করুন এই ডাইনিকে…যতো দ্রুত সম্ভব!”
.
অধ্যায় ৭
অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে রোমানার আর ভালো লাগছে না। রিগ্যাল এয়ারওয়েজের সেলস এক্সিকিউটিভ সে। তার ছোট্ট, কিউবিকল সদৃশ অফিসটি ঢাকা বিমানবন্দরের আভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল ভবনের নীচতলায় অবস্থিত। তারা মোট তিনজন কাজ করে এখানে। অসুস্থতার কারণে একজন অনুপস্থিত। আজকে সুমিত নামের এক জুনিয়র আর রোমানা কাজ করছে। তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা হচ্ছে না, এখন বলতে গেলে অফ সিজন। এই মওসুমে পর্যটক কম থাকে, ফলে বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইটের সংখ্যাও কমে আসে, কমে আসে তাদের ব্যস্ততাও।
শেষ ফ্লাইটটা ছিলো বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে, এরপরও পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করতে হয়। কেউ কেউ মোবাইলফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু রোমানা আবার বইয়ের পোকা, সাধারণত পকেটবুক সাইজের পেপারব্যাক বের করে পড়ে সে। এ নিয়ে তার কিছু কলিগ হাসাহাসি করে, খোঁচা মেরে তাকে প্রফেসর আপা বলে ডাকে। আজকেও সে পিডি জেমসের একটি ডিটেক্টিভ বই হাতে নিয়েছিলো কিন্তু গল্পটা তাকে টানেনি। কম্পিউটারে বসে একটা গেম খেলারও চেষ্টা করেছিলো, সেটা আরো বেশি বিরক্তিকর লেগেছে। অগত্যা চুপচাপ বসে আছে সে। আর এক ঘণ্টা পর ছুটি, এই এক ঘণ্টাকে সহ্য করতে একটু বেশিই কষ্ট করতে হয়। সারাটা দিন কাজে ডুবে থাকলে কী হবে, ছুটির আগের সময়টায় এসে এক ধরণের অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়-কখন বাড়ি যাবো!
রোমানা ঠিক করলো কফি খাবে, ছুটির আগে সব সময়ই এটা করে সে।
“কই যান, আপা?” জুনিয়র ছেলেটা তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে জানতে চাইলো। এতোক্ষণ কম্পিউটারে সেলসের হিসেব দেখছিলো সে।