ভাগ্য ভালো, পরহেজগার মহিলার বেশে ছিলো, তাই ছফা তাকে দেখতেই পায়নি। তবে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসেই দূর থেকে ছবিটা দেখে চিরতে পারে।
অবিশ্বাস্য! ছফা কিভাবে এ ছবি পেলো? কিভাবে জেনে গেলো, সে এখন ঢাকায়? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা ছিলো না তার। তবে এখন সেই প্রশ্নের উত্তর সে জানে-আর্জুমান্দ বেগম। ও-ই ছবিটা দিয়েছে ছফাকে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুশকান, সুস্মিতার দিকে তাকালো সে। তার চোখে ভেসে উঠলো সেই দিনগুলোর দৃশ্য। সত্যি বলতে, সুন্দরপুর থেকে পালানোর বছরখানেকেরও বেশি পরে, যেদিন এই মেয়েটা হুট করে চলে এলো কলকাতায়, সেদিনই ওর নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গেছিলো!
.
অধ্যায় ৯৭
মুশকানের কলকাতা পর্ব
সুন্দরপুর থেকে ঢাকায় চলে আসার পর এমপি আসাদুল্লাহর সাথে লেনদেন চুকিয়ে বর্ডার দিয়ে কলকাতার সল্টলেকে ডাক্তার আসকারের শ্বশুড় বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলো মুশকান। চাইলে সে পাসপোর্ট ব্যবহার করেই যেতে পারতো, ছফা তখনও হাসপাতালে, পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে তদন্ত করলে ছফা জেনে যেতে পারবে, সে কলকাতায় চলে গেছে।
আসকারের স্ত্রী শুভমিতা মারা যাবার পর থেকে তার বড় বোন পারমিতা থাকতো সল্টলেকের বাড়িতে। সে-ও যখন মারা গেলো তখন থেকে বাড়িটা খালিই পড়েছিলো। ফলে, ওই বাড়িটা হয়ে ওঠে মুশকানের নতুন ঠিকানা, উপযুক্ত একটি আশ্রয়!
ওখানে গিয়ে প্রায় এক বছরের মতো সময় একেবারেই চুপচাপ ছিলো মুশকান। তারপরই সিদ্ধান্ত নেয় এভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে আর থাকবে না। চেহারাটা পাল্টে ফেললে আর নতুন একটি নাম পরিচয় থাকলে সব দিক থেকেই সে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে। নুরে ছফার হাত থেকে তো বাঁচবেই, এমন কি দেশে গিয়েও থিতু হতে পারবে!
কিন্তু এরকম কাজের জন্য দক্ষতার চেয়েও বেশি দরকার ছিলো বিশ্বস্ত একজন ডাক্তারের। কলকাতায় ডিপি মল্লিক নামে এক প্লাস্টিক সার্জনের সাথে আসকারের বেশ ভালো জানাশোনা ছিলো। তার মাধ্যমেই কাজটা করা যাবে।
তো একদিন সেই ডিপি মল্লিকের সাথে ফোনে কথা হয়, মুশকানের কাছ থেকে জেনে নেয়, সে কী চায়। সার্জন জানায়, তার চেহারার অনেকটুকুই পাল্টে ফেলা যাবে, এর জন্যে দরকার হবে একাধিক সার্জারির। মোট কতো খরচ হবে সেটাও জানিয়ে দিয়েছিলো ভদ্রলোক। ব্যস্ত শিডিউল দেখে খুব শিগগিরই জানিয়ে দেবে কবে থেকে কাজ শুরু করবে। কিন্তু ডিপি মল্লিক ক-দিন পর যখন সল্টলেকের বাড়িতে আসে কথাবার্তা চূড়ান্ত করার জন্য তখন মুশকানের পিলে চমকে দেয়।
আমি জানি আপনি কে! রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননির সেই কুক!…সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে এসছেন!…পুলিশ আপনাকে খুঁজছে!
মুশকান স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, কলকাতার এই সার্জন চিনে ফেলবে তাকে। সত্যিটা হলো, বেশ কয়েক বছর আগে, রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে, ডাক্তার আসকারের আমন্ত্রণে অরিয়েন্ট হাসপাতালে প্লাস্টিক সার্জারির উপরে একটি সেমিনারে অংশ নিতে ঢাকায় গিয়েছিলো ডিপি মল্লিক, তখন ডাক্তারই তাকে সুন্দরপুরে নিয়ে গিয়ে রবীন্দ্রনাথে লাঞ্চ করান। কিন্তু ঘটনা এখানে থেমে থাকলে সমস্যা হতো না। এই ডিপি মল্লিক নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টসহ তার পেইজে ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ নামের অদ্ভুত রেস্টুরেন্টের ছবি আর খাবারের প্রশংসা করে পোস্ট দিয়েছিলো। এই পোস্টে সুন্দরপুরের এক তরুণ কমেন্ট করে, সেই সূত্রে সার্জনের সাথে তার পরিচয়ও হয়, ঠাঁই করে নেয় ভদ্রলোকের ফ্রেন্ডলিস্টে। পরবর্তীতে ঐ তরুণই তাকে জানিয়েছিলো, কী এক কারণে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মালেকিন সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে যাবার পর রেস্টুরেন্টটি বন্ধ হয়ে গেছে। মহিলা এখন ফেরারি আসামি। তবে ঠিক কী কারণে পুলিশ তাকে খুঁজছে সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে।
এরকম খবর শোনার পর ভোজনরসিক মল্লিক একটু কষ্টই পেয়েছিলো, সেই সাথে কৌতূহলিও হয়েছিলো মুশকানের ব্যাপারে। এরকম গুণী মহিলা কী এমন কাণ্ড করলো যে, তাকে ফেরারি হতে হলো!
ডাক্তার আসকার তাকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, তমান্না রহমান নামে তার এক আত্মীয়ার সার্জারি করে দিতে হবে, সে এখন কলকাতায়ই আছে। কাজটা করতে হবে সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সাথে। কিন্তু সল্টলেকের বাড়িতে মুশকানকে দেখেই ডিপি মল্লিক চিনে ফেলে এ হলো ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’র সেই বিখ্যাত কুক! যার খাবার খেয়ে এবং যাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো। ডিপি মল্লিকের বুঝতে সমস্যা হয়নি ঘটনা আসলে কী-মুশকান গুরুতর কোনো অপরাধ করে দেশ থেকে পালিয়ে এখানে চলে এসেছে।
মুশকান প্রথমে ভেবেছিলো লোকটা ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করবে, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সার্জন জানায়, তার চাওয়া খুবই সামান্য একটু সান্নিধ্য পেতে চায় তার! আর কিছু না।
এর অর্থ বুঝে নিতে কোনো সমস্যাই হয়নি তার। প্রস্তাবটি পেয়ে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, বরং একটু ভেবে, লোকটাকে অবাক করে দিয়ে জানায়, সে রাজি আছে তবে কিছু শর্ত আছে তার। উদগ্রীব হয়ে মল্লিক জানতে চায় শর্তগুলো কি। মুশকান জানায়, এটা একবারই হবে, এর পর আর কখনও ব্ল্যাকমেইল করবে না, কোনোভাবেই না! এই ব্যাপারটা পুরোপুরি গোপন রাখতে হবে, যেমন গোপন রাখতে হবে তার প্লাস্টিক সার্জারির কথাটাও। যতো দ্রুত সম্ভব করে দিতে হবে সেটা!