“ও এখানে আসবে না,” শান্ত কণ্ঠে বললো মুশকান। একটু আগে ডাক্তার আসকারের সাথে কথা হয়েছে তার–বলে দিয়েছে, তারা দুজনেই নিরাপদে আছে।
“কেন?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটার দিকে তাকালো। কারণ ওকে ফলো করে নুরে ছফা আর তার লোকজন এখানে চলে আসতে পারে।”
“ও,” আর কিছু না বলে ভেঁজা চুলগুলো টাওয়েলে মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সুস্মিতা। মুশকানের দিকে চোখ গেলো। স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। “কী হয়েছে? ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
গভীর করে দম নিলো মুশকান। একটা অস্বস্তি পেয়ে বসেছে তাকে, কিন্তু সেটা নিয়ে কথা বলতে পারছে না।
“ফোনটা কেন বন্ধ হয়ে গেছিলো, তাই তো?”
মুশকান কিছু বললো না।
“ঐ গাঙুটাকে ইয়ে করার সময় সিট থেকে পড়ে গেছিলো ওটা,” নির্বিকার কণ্ঠে বললো সুস্মিতা। “তখনই বন্ধ হয়ে যায়!”
পিএসের লোকটার সাথে সুস্মিতার ধস্তাধস্তির আওয়াজ মুশকানও শুনেছে। “তুমি তাকে কী করেছো?” ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো।
রহস্যময় হাসি দিলো সুস্মিতা সমাদ্দার।
“হেয়ালি না করে স্পষ্ট করে বলো!”
“অমন করে তাকাবে না আমার দিকে, চুল মুছতে মুছতে বললো। “তুমি হলে যা করতে, তা-ই করেছি।”
সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মুশকান।
“সামান্য একটা নাইলনের দড়ি দিয়েই ঘায়েল করেছি। ওটা দিয়েই আমাকে বেঁধে রেখেছিলো। ওখান থেকে বের হবার সময় ওটা নিয়ে নিয়েছিলাম, ওদের কেউ দেখেনি।” মুশকান কিছু বলছে না দেখে আবার বললো, “ঐ লোকটা খুব বাজে ছিলো। আমারও সন্দেহ হচ্ছিলো, সে উল্টাপাল্টা কিছু করতে পারে তাই দড়িটা নিয়ে নিয়েছিলাম।”
“তুমি ওকে মেরে ফেলেছো?!” সরাসরিই জিজ্ঞেস করলো এবার।
“বললাম তো, কিচ্ছু করার ছিলো না। ও আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলো…খুব বাজে ইনটেনশান ছিলো ওর…বিলিভ মি।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুশকান। “ঠিক আছে, বুঝলাম কিন্তু…” কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না।
“কি?”
“তুমি আর কিছু কররানি তো?”
সুস্মিতা স্থিরচোখে চেয়ে রইলো মুশকানের দিকে। তারপর কাঁধ খুলে বললো, “আর কী করবো?”
গভীর করে দম নিয়ে নিলো মুশকান। “ওই লোকটার ডেড বডি অটোপসি করলে-”
কথার মাঝে হেসে ফেললো সুস্মিতা। “তুমি আমাকে এতোটা ইম্যাচিউর ভাবো কেন বুঝি না,” চুল মুছতে মুছতে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো। “ওকে গাড়িটাসহ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছি। এতোক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।”
ভুরু কপালে তুললো মুশকান। “কিন্তু বৃষ্টির কথাটা কি মাথায় আছে তোমার?”
“বৃষ্টি নেমেছে তার একটু পর।”
“তোমার কি ধারণা, ততোক্ষনে লাশটা পুরোপুরি পুড়ে গেছে?”
কাঁধ তুললো সুস্মিতা। “আই ডোন্ট হ্যাভ এনি আইডিয়া।” তারপর রহস্য করে বললো, “প্রথমবার পোড়ালাম তো, বুঝতে পারছি না কতোক্ষণ লাগতে পারে!”
আক্ষেপে মাথা দোলালো মুশকান। “তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
ঠোঁট ওল্টালো মেয়েটা।
অস্বস্তিটা জোর করে মাথা থেকে তাড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলো সে। “আমরা একটু পরই এখান থেকে চলে যাবো।”
“কোথায়?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো।
“এসব তোমার না জানলেও চলবে।”
কাঁধ তুললো আবার। “ওকে। আমরা দুজন একসঙ্গে থাকবো, এটাই বড় কথা।”
হ্যাঁ বা না, কিছুই বললো না মুশকান। এই মেয়েটার সঙ্গে থাকার কোনো ইচ্ছে তার নেই কিন্তু পরিস্থিতি এমনই, সেটা করতে হবে এখন। অন্তত কিছু দিনের জন্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে জানালা দিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো সে। প্রায় সারাটা জীবন যাযাবরের মতো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ালো। দীর্ঘ যৌবন তার, দীর্ঘ জীবনও পাবে সম্ভবত, কিন্তু থিতু হওয়া তার কপালে নেই!
“আচ্ছা, ঐ নুরে সাফা লোকটা কিভাবে সার্জনের কথা জেনে গেলো?”
সুস্মিতার কথায় ফিরে তাকালো মুশকান। এটা নিয়ে সে-ও অনেক ভেবেছে, কোনো সদুত্তর পায়নি। সুকুমারের ব্যাপারটা না-হয় কলকাতার পুলিশের নজরে চলে এসেছিলো, কিন্তু ডিপি মল্লিকের নিখোঁজের ঘটনায় ওখানকার পুলিশ তাকে সন্দেহ করেনি। আসকার তাকে শুধু বলেছে, কিভাবে যেনো মাস্টারকে লেখা চিরকুটটা ছফা হস্তগত করে ফেলেছে, তারপর সেটার সূত্র ধরেই ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিনকে পাকড়াও করে সে। ঐ লোকই খোঁজ দিয়ে দেয় আসকারের, কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো কিছুই আদায় করতে পারেনি ডিবি অফিসার। এবার বেশ শক্ত ছিলো ডাক্তার, আগের বার কেএস খানের কথার ফাঁদে পড়ে নার্ভাস ব্রেক ডাউনের শিকার হয়েছিলো সে। তবে আসকারের দেশি পাসপোর্টটা জোর করে নিয়ে নেয় ছফা। ঐ পাসপোর্ট দেখে না-হয় ডিবি অফিসার বুঝে গেলো, ওর কলকাতায় ঘন ঘন যাতায়াতের কথাটা, কিন্তু মুশকান কোথায় থাকে, ডিপি মল্লিকের নিখোঁজ হবার সাথে তার জড়িত থাকার কথা জানলো কিভাবে?
তার চেয়েও বড় কথা, আসকারের বাড়িতে হানা দেবার আগেই ছফা টের পেয়ে গেছিলো সে ঢাকায় গেছে! পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে গেছিলো সে, দু-দিন পর ঢাকা থেকে যশোরের ডামেস্টিক ফ্লাইট ধরার জন্য রওনা দিয়ে ট্রাফিক জ্যামে পড়ে যায়, ফ্লাইটটা মিস্ করে বসে। ফাইন দিয়ে ফ্লাইটটা যখন রিশিডিউল করে লাউঞ্জে অপেক্ষা করছিলো তখনই দেখতে পায় নুরে ছফা বিমানবন্দরে চলে এসেছে। হাতে একটা ছবি নিয়ে ফ্রন্ট ডেস্কে কথা বলছে সে।