আসলাম টের পায়, চোখ খোলা রাখলেও অন্ধকার নেমে আসছে চারপাশে! সেই অন্ধকারে ভেসে উঠলো তার ছেলে আরাফের মুখটা! কতোদিন তাকে দেখেনি। স্ত্রী হত্যার ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে তার ছেলেকে ওর নানা-নানী নিজেদের কাছে নিয়ে নেয়।
আরো দুটো মুখও ভেসে উঠলো এরপর!
তার স্ত্রী সোমা! আর মনীষা দেওয়ান!
এদের সবাইকে সে হারিয়েছে। এখন সে-ও হারাবার পথে!
“মুশকানকে পেলে কী করবি…সেটাই শুধু মাথায় রেখেছিলি!” দম ফুরিয়ে গেলেও কিড়মিড় করে কথাটা বলে সুস্মিতা। “কিন্তু তোদেরকে পেলে…” আরেকটু জোরে টান দিয়ে বলে, “আমরা কী করবো…একদমই ভাবিসনি!”
আমরা!
অন্তিম মুহূর্তে আসলামের মনে হয়, একজন নয়, দু দু-জন মুশকান জুবেরির খপ্পরে পড়েছে সে!
এরপরই পরিস্থিতিটাকে আরো বেশি রোমহর্ষক করে দিয়ে একটু আগে গাওয়া গানটার বাকি অংশ গাইতে শুরু করে সুস্মিতা :
“রাত্রি যেমন লুকিয়ে রাখে আলোর প্রার্থনাই
তেমনি গভীর মোহের মাঝে তোমায় আমি চাই…”
আসলাম টের পায় অপার্থিব এক ভয় জেঁকে বসেছে তার মধ্যে। এরপর সুস্মিতা গাইলো কি গাইলো না, বুঝতে পারেনি। আর কোনো শব্দ তার কানে ঢোকেনি। দৃশ্যের পর শব্দও উধাও হয়ে যায়! শুধু ভো ভো আওয়াজ শুনতে পায় সে।
এর কয়েক মুহূর্ত পরই স্থির হয়ে যায় মাহবুব আসলামের পঁয়ত্রিশ বছরের সুঠাম দেহটি।
.
অধ্যায় ৯৬
মুশকান বসে আছে একটি ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্টে।
বৃষ্টি এখন কমে এসেছে। জায়গাটা গুলশান আর বনানী থেকে খুব কাছেই, বারিধারার একটি অ্যাপার্টমেন্ট-অরিয়েন্ট হাসপাতালেরই সম্পত্তি। প্রায়শই বিদেশ থেকে কনসালটেন্ট আর গেস্ট ডাক্তাররা আসে, তাদের থাকার জন্য স্থায়ীভাবে এই অ্যাপার্টমেন্টটি কেনা হয়েছে। আজকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক ভারতীয় কার্ডিয়াক স্পেশালিস্ট ছিলেন, এখন একদম ফাঁকা।
শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা মতোই কাজটা করতে পেরেছে সে। কাজ শেষে ওখান থেকে বের হয়ে গাড়িতে করে সোজা বারিধারার এই অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসেনি মুশকান। সুস্মিতাকে পিক করে নিয়ে আসার কথা ছিলো, কিন্তু মেয়েটার ফোন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেলে খারাপ কিছুর আশঙ্কা করে। কল কেটে যাবার আগে সুস্মিতা আর পিএসের ঐ লোকটার কথা শুনেছে-নির্ঘাত বিপদে পড়েছে মেয়েটি। আবার! তার এই পরিকল্পনাটিও ভণ্ডুল হয়ে গেলো বুঝি! তাই গুলশান দুই নম্বরে পিএসের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে আসকারের পাঠানো গাড়িতে উঠে বসলেও তার জানা ছিলো না কোথায় যাবে। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়, সুস্মিতাকে যেখানে নামিয়ে দেবার কথা বলেছিলো সেখানে গিয়েই অপেক্ষা করা উচিত।
আসকারের পাঠানো লোকটাকে সে কথা বলতেই গাড়িটা ছুটে যায় বনানীর পাঁচ নাম্বার রোডের দিকে। রাতের এ সময়ে পথঘাট ফাঁকা পেয়ে অল্প কিছুক্ষণ পরই চলে যায় সেখানে। রাস্তার এক পাশে গাড়িটা পার্ক করে অপেক্ষা করতে থাকে মুশকান। এছাড়া আর কিছু করারও ছিলো না তার।
কয়েক মিনিট পরই, তার নার্ভের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিয়ে ফোনটা বেজে ওঠে। কলার আইডি দেখে সে ভেবেছিলো পিএস, পরক্ষণেই বুঝতে পারে, এই ফোনটা সুস্মিতার কাছে ছিলো বন্দীদশা থেকে মুক্ত হবার সময়।
সুস্মিতার কণ্ঠ শোনামাত্রই মুশকানের সমস্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা উবে যায় এক মুহূর্তে। মেয়েটা জানায়, সে একটা রিক্সা নিয়ে রওনা দিয়েছে বনানীর পাঁচ নাম্বার রোডের উদ্দেশে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওখানে চলে আসে সুস্মিতা। দূর থেকেই দেখতে পায়, বৃষ্টিতে ভিজে জবুথুবু হয়ে রিক্সায় করে আসছে মেয়েটি। প্যাসেঞ্জার ডোরটা খুলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে মুশকান। সুস্মিতা দেখতে পেয়ে রিক্সাটা থামায় গাড়ির পাশে। ভাড়া মিটিয়ে মেয়েটা গাড়িতে ওঠার পরই মুশকান দেখতে পায় তার চোখের নীচে কালশিটে পড়ে গেছে, আর তার জামায় লেগে আছে রক্ত!
“কী হয়েছে তোমার?! তুমি ঠিক আছে তো?” উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ওঠে সে।
“আমি ঠিক আছি…ডোন্ট ওরি,” শান্ত কণ্ঠে বলে সুস্মিতা। “পরে সব বলবো।”
যাই হোক, বারিধারার এই অ্যাপার্টমেন্টে আসার পথে গাড়িতে তারা এ নিয়ে আর কোনো কথা বলেনি আসকারের লোকটার উপস্থিতির কারণে। কিন্তু এই ফ্ল্যাটে ঢুকতেই মুশকান প্রথমে জানতে চায়, সে কেন ফোনটা বন্ধ করে দিয়েছিলো হুট করে? তার শরীরে কীসের রক্ত লেগে আছে?
এমন প্রশ্নে রহস্যময় হাসি দিয়েছিলো সুস্মিতা। তাকে জানায়, আগে ভেজা কাপড় ছেড়ে স্নান করবে, তারপর সব খুলে বলবে তাকে–এ কথা বলেই বাথরুমে ঢুকে পড়ে সে।
এখনও বাথরুমে যাওয়ার নিচ্ছে সুস্মিতা।
মেয়েটা সত্যি অদ্ভুত! মনে মনে বললো মুশকান। খুব বেশি দিন হয়নি তার সাথে সাথে পরিচয়, কিন্তু এখন এই পৃথিবীতে ডাক্তার আসকার ছাড়াও আরেকজন ঘনিষ্ঠজন রয়েছে তার। কিন্তু মেয়েটার কিছু কিছু আচরণে সে যেমন দুশ্চিন্তায় থাকে তেমনি অস্বস্তি বোধ করে!
মাথার চুল টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে মুশকানের বিপরীতে একটি সিঙ্গেল সোফায় বসলো সুস্মিতা।
“ও আসবে না?” জানতে চাইলো সে।
অবাক হয়ে তাকালো মেয়েটার দিকে। তার মধ্যে কোনো বিকারই নেই। অথচ আজকে দুপুর থেকে একটু আগ পর্যন্ত কতোগুলো পিশাচের হাতে বন্দী ছিলো সে। টর্চারেরও শিকার হয়েছে। কে জানে কতোটা ভয়াবহতার ভেতর দিয়ে গেছে!