এখন পাশের ঘর থেকে আর্জুমান্দ বেগমের ঘরে ঢুকতেই টের পেলো মহিলার ঘুম ভেঙে গেছে আবার। একটু নড়াচড়া করছে সে। ঘুম হয় না বলে আই মাস্ক লাগানো আছে তার চোখে, ফলে দেখতে পাচ্ছে না।
“কে?” অস্ফুট স্বরে বললো রোগী।
মুশকান তার পাশে চুপচাপ বসে রইলো। চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সম্ভবত কিছুক্ষণের মধ্যে পুরোপুরি মুক্তি পেয়ে যাবে সুস্মিতা।
“কথার জবাব দিচ্ছো না কেন?” মৃত্যুপথযাত্রি রোগী একটু জোরেই বলার চেষ্টা করলো, যদিও ভঙ্গুর কণ্ঠে তেমন জোর নেই। “আবারো ফেসবুক ইউজ করছো আমার সামনে?”
মুশকান অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।
“তোমাকে জেবুন্নেসা না ডেকে ফেবুন্নেসা ডাকাই উচিত,” ভঙ্গুর কণ্ঠে বললো আর্জুমান্দ বেগম।
নিঃশেব্দ হেসে ফেললো মুশকান। আগের মতোই টিটকারি মারার স্বভাব রয়ে গেছে। এমন সময় দেখতে পেলো, রোগী তার চোখের উপর থেকে আই মাস্কটা খুলে ফেলতে উদ্যত হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে আর্জুমান্দ বেগমের হাতটা খপ করে ধরে ফেললো সে।
“কে?!” ভড়কে গেলো পিএসের বোন। অন্য হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করলো মুশকানের হাতটা।
“একদম শান্ত থাকো…আরজু!”
অবিশ্বাসের অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো রোগীর চেহারায়। “আরজু!” পুণরুক্তি করলো। “কে?!” ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো এবার।
“অনেক পুরনো বন্ধু। হয়তো তোমার স্মৃতিতে সে আর নেই!”
অস্থির হয়ে উঠলো রোগী। “কে? কে কথা বলছে? নাম বলো…নাম বলো!” হাপাতে হাপাতে বলে গেলো রোগী।
“আহ্,” আস্তে করে বললো মুশকান। “এতো অস্থির হলে তোমার শরীর খারাপ করবে। শান্ত হও। তোমার কোনো ভয় নেই।”
“আমি তোমাকে দেখতে চাই!” দৃঢ়তার সাথে বললো রোগী। “আমার আই মাস্কটা খুলে দাও।”
মুশকান কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলো। রোগীকে দেখা দেবে কিনা দ্বিধায় পড়ে গেছে সে, কিন্তু তার সমস্ত দ্বিধা উবে গেলো মুহূর্তে। হঠাৎ করেই ইয়ারফোনে শুনতে পেলো সুস্মিতা গান গাইছে!
মেয়েটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এটা না ভেবে পারলো না। এরপর পিএসের যে লোক গাড়িতে করে তাকে নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দেবে তার সাথে কথাবাতা কেমন অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে সেটাও কানে গেলো।
লোকটা তার মত বদলে ফেলেছে! সে সুস্মিতাকে মুক্তি দিতে চাইছে না!
উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালো মুশকান। “হ্যালো?!” প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো। “সুস্মিতা!” কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলো ফোনটা সুস্মিতার কানে নেই। সুস্মিতা আর সেই লোকটার কথাবার্তা শুনে মুশকানের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। কিছুই বুঝতে পারছে না। এরপরই ধস্তাধস্তির শব্দটা শুনতে পেলো, আর সঙ্গে সঙ্গে কেটে গেলো কলটা!
মাই গড!
দ্রুত নাম্বারটায় আবার ডায়াল করলো মুশকান। ওপাশ থেকে যখন অটোমেটেড অপারেটরের কণ্ঠটা বললো সংযোগ বন্ধ আছে, তখন আর দেরি না করে দ্রুত বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।
কিন্তু সে জানতেই পারলো না, এক ঝলকের জন্য আর্জুমান্দ বেগম। হাত দিয়ে চোখের উপরে থাকা আই মাস্কটা খুলে তাকে দেখে ফেলেছে।
মৃত্যুপথযাত্রি রোগী সুতীব্র ভয় আর অবিশ্বাসে কাঁপতে শুরু করলো রীতিমতো। যেনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে।
.
অধ্যায় ৯৩
আশেক মাহমুদের গাড়িটা ছুটে চলেছে তার গুলশান দুই নম্বরের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে।
একমাত্র দারোয়ান বদরুলকে ঐ বিরাণ বাড়িতে রেখে ড্রাইভার সেলিমকে নিয়ে রওনা দিয়েছে পিএস। অন্য কোনো সময় হলে এই সরকারী গাড়িটা চালাতে নিয়মিত একজন ড্রাইভার, কিন্তু আজকের রাতের জন্য আশেক মাহমুদ বেছে নিয়েছে তার আরেকজন বিশ্বস্ত লোক সেলিমকেই।
পিএস বসে আছে পেছনের সিটে, ছফা বসেছে ড্রাইভারের পাশে। গাড়িটা পথে নামতেই শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টি। প্রথমে বড় বড় ফোঁটায়, তারপর ঝমঝম করে। এরই মধ্যে ছুটে চলেছে তাদের গাড়িটা। বিরূপ প্রকৃতি পিএসকে পরিহাসের সাথে মনে করিয়ে দিচ্ছে, সব কিছুই তার বিপক্ষে চলে গেছে এখন।
একটু আগে ছফা তার জুনিয়র জাওয়াদকে দ্রুত বাইক নিয়ে চলে আসতে বলেছে পিএসের গুলশানের অ্যাপার্টমেন্টে। যে কাজটা করতে হবে তাতে জাওয়াদ ছাড়াও আরো অনেক লোকবল লাগবে। তবে সবার আগে পিএসের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছাতে হবে তাকে, ওখান থেকেই শুরু করতে হবে বিশাল এক কর্মযজ্ঞের।
আশেক মাহমুদের অ্যাপার্টমেন্টের মেইনগেটের সামনে তাদের গাড়িটা থামতেই পিস্তলের সেফটি লক খুলে পেছনে ফিরে তাকালো ছফা।
“আপনি এখানেই থাকুন, স্যার।”
পিএসের চোখেমুখে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো। “আপনি কি মনে করছেন, ঐ মহিলা এখনও আমার অ্যাপার্টমেন্টে আছে?”
“না,” কথাটা বলেই ছফা গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হলো বৃষ্টির মধ্যেই। “কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে ওখানে ঢাকা ঠিক হবে না।”
অ্যাপার্টমেন্টের গেটের পাশে যে ছোট্ট ওয়াচরুমটা আছে সেখানে ডিউটিতে থাকা দারোয়ান পিএসের গাড়িটা দেখে বের হয়ে এসেছে এতোক্ষণে।
বৃষ্টির ছটা থেকে বাঁচতে ওয়াচরুমের শেডের নীচে এসে দাঁড়ালো ছফা। “একটু আগে কি একজন মহিলা বের হয়ে গেছে এখান থেকে?…কিছুক্ষণ আগে ঢুকেছিলো সম্ভবত?”
দারোয়ান মাথা নেড়ে সায় দিলো। “জি, স্যার। একটু আগেই বাইর হইসে।”
“কতোক্ষণ আগে?”
একটু ভেবে নিলো দারোয়ান। “দশ-বারো মিনিট তো হইবোই?”
ছফা জানতো এমন জবাবই পাবে। “কোন্ দিক দিয়ে গেছে ঐ মহিলা…দেখেছো?”