“কাল বুবু আমার কাছে জানতে চেয়েছিলো, তার ছেলের কেসটার কী অবস্থা।”
সম্বিত ফিরে পেলো ছফা, আবারো মনোযোগ দিলো প্রধানমন্ত্রীর পিএসের কথাবার্তার দিকে।
“বুঝতেই পারছেন, খুব বেশি সময় তো আর নেই,” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশেক মাহমুদ। “বুবু খুব করে চাইছে, তার ছেলের কী হয়েছিলো সেটা জানতে…কে তার এতো বড় সর্বনাশ করলো, কেন করলো।”
“জি, স্যার…এটা খুবই স্বাভাবিক।”
“কিন্তু আমি তো তার এমন অবস্থায় খারাপ কোনো সংবাদ দিতে পারি, পারি কি?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা।
“আমি তাকে শুধু জানালাম, হাসিবের শেষ গন্তব্য ছিলো মুশকান জুবেরির ঐ রেস্টুরেন্টটায়…কী যেনো নাম…রবীন্দ্রনাথ ওখানে…?”
“রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি…” ছফা বলে দিলো।
“হুম। বুবুকে বললাম, সুন্দরপুরের ঐ রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলো হাসিব, তারপর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তার।” একটু থেমে আবার কফির কাপে চুমুক দিলো। “যখন তাকে বললাম, মুশকান কে, কী করে, দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছিলো, একজন মেডিকেল ডাক্তার, বিয়ের আগে তার নাম ছিলো মুশকান সোহেলি…তখনই বুবু চমকে ওঠে।”
ছফাও চমকে উঠলো সত্যি সত্যি। “উনি ঐ মহিলাকে চিনতেন?!”
মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক মাহমুদ। “হুম। কী আর বলবো, আমেরিকায় যাওয়ার পর বুবুরা ঐ মহিলারই প্রতিবেশী ছিলো!”
“বলেন কী, স্যার!”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ভদ্রলোক। “দুনিয়াটা আসলেই ছোটো!”
কাকতাল আর ঘটনাচক্র নিয়ে ছফা বরাবরই অবাক হয় কিন্তু এরকম কাকতালীয় ঘটনার কথা শুনে যারপরনাই বিস্মিত সে। নিজের বিস্ময় আর লুকাতে পারলো না।
“আন্দিজ থেকে বেঁচে যাওয়ার কয়েক বছর পরের ঘটনা এটি,” বললো আশেক মাহমুদ। “মুশকান সোহেলির নরমাংস খাওয়ার কথাটা কিভাবে যেনো বাঙালি কমিউনিটিতে জানাজানি হয়ে গেলে মহিলা রীতিমতো একঘরে হয়ে পড়ে।”
ছফাও আনমনে তার কফির কাপটা তুলে নিলো এবার।
“যাই হোক, এসব জানাজানির আগেই আমার বুবুর সাথে ঐ মহিলার বেশ সখ্যতা হয়ে গেছিলো, প্রায় সমবয়সী ছিলো তারা। যে ছবিটা দেখছেন সেটা তখনকার সময়ই ভোলা। ওরা আরো কিছু বন্ধুবান্ধবসহ একটা পার্কে গেছিলো পিকনিক করতে, তখন এই ছবিটা তুলেছিলো আমার বুবু।”
ছফা অবাক হয়ে আশেক মাহমুদের দিকে তাকিয়েই কফিতে প্রথম চুমুকটা দিলো। সে উন্মুখ হয়ে আছে বাকি কথাগুলো শোনার জন্য।
আশেক মাহমুদ যখন তার বোনের কাছ থেকে শুনতে পেলো মুশকান সোহেলি নামের একজনকে সে চিনতো বহুকাল আগে, তখন ভেবেছিলো এটা হতেই পারে না। যে মুশকান হাসিবের অন্তর্ধানের জন্য দায়ী সে কোনো যুবতীই হবে-তা না হলেও মাঝবয়সী কোনো মহিলা হবে নির্ঘাত। কিন্তু সত্তুর বছরের কোনো নারী? অসম্ভব। এদিকে, নুরে ছফা তাকে বলেনি মুশকান জুবেরির বয়স কতো ছিলো। কঠিন এক অনিশ্চয়তা আর দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায় সে।
যাইহোক, তার বুবু এতোটা কাকতালীয় ঘটনা মেনে নিতে পারেনি। কানাডায় ফোন করে মেয়ের কাছে থাকা তার পুরনো ছবির অ্যালবাম থেকে মুশকানের একটি ছবি মেইল করে দিতে বলে, তারপর সেই ছবিটা দেখায় আশেককে। ছবি দেখে পিএস বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ পঁচাতুর সালেও মহিলা পরিপূর্ণ যুবতী ছিলো, প্রায় তার বুবুর বয়সী একজন। এরকম একজনের সাথে কী করে হাসিব হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়াবে?
কিন্তু ছফার কাছ থেকে মুশকান জুবেরি সম্পর্কে যা যা শুনেছে সেগুলোর প্রায় সবটাই মিলে যাচ্ছে বিয়ের আগের নাম মুশকান সোহেলি। পেশায় মেডিকেল ডাক্তার। আমেরিকায় ছিলো দীর্ঘদিন। পরে দেশে চলে আসে! এটাকে যেকোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ কাকতালীয় ঘটনা বলে মেনে নেবে না। এরপরই আশেক মাহমুদের বড় বোন জানায়, মুশকান সোহেলি আন্দিজের প্লেন ক্র্যাশ থেকে বেঁচে যাওয়াদের একজন। আর তার নরমাংস খেয়ে বেঁচে থাকার অবিশ্বাস্য, গা গুলিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাটি।
নিশ্চিত হবার জন্য আশেক ছবিটা নিয়ে নেয় ছফাকে দেখাবে বলে। এখন সে দেখতে পাচ্ছে, তার বুবুর কথাই ঠিক।
“আস্ত একটা ডাইনি এই মহিলা,” কফির কাপ রেখে কথাটা আবারো বললো আশেক মাহমুদ। “এতোদিন আপনার কাছে তার কোনো ছবি ছিলো না, এখন আছে। আর ভাগ্য ভালো, পুরনো ছবিটাই কাজে লাগবে। কারণ। ঐ ডাইনি অলৌকিকভাবেই নিজের বয়স ধরে রেখেছে!”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। অনেক চেষ্টা করেও মুশকান জুবেরির কোনো ছবি জোগাড় করতে পারেনি সে। এমনকি সুন্দরপুরের জমিদারের বিশাল সহায়সম্পত্তি ট্রাস্ট করে দেয়ার যে কাগজপত্র সেগুলো খতিয়েও দেখেছে, কোনো লাভ হয়নি। ছফা অবাক হয়ে দেখেছে, ওখানে মালিক হিসেবে মুশকান জুবেরির কোনো ছবি নেই-রাশেদ জুবেরির ছবি দেয়া! আর ট্রাস্টের সমস্ত কাগজপত্র রাশেদ জুবেরি মারা যাবার আগেই তৈরি করা হয়েছে!
“সে কোনো সিরিয়াল কিলার নয়…মানুষখেকো এক ডাইনি,” দাঁতে দাঁত পিষে বললো আশেক মাহমুদ। “মানুষ খেয়ে খেয়েই সে নিজের যৌবন ধরে রেখেছে। এছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না আমি।”
ছফা চোখেমুখে বিস্মিত হবার অভিব্যক্তি ধরে রাখলেও মুখে কিছু বললো না। নিজের অভিনয় দক্ষতার উপরে তার খুব বেশি আস্থা নেই।
“আরেকটা ঘটনার কথাও বুবু আমাকে বলেছে।”
“কী ঘটনা, স্যার?” কৌতূহলি হয়ে উঠলো ডিবির নুরে ছফা।