বাঁকাহাসি দিলো আশেক মাহমুদ। “অবিশ্বাস্য ঘটনা…বুঝলেন? কিন্তু এটাই ঘটেছে।”
মাথা দোলালো নুরে ছফা। তার বিশ্বাস হচ্ছে না-এমন একটা ভঙ্গি করার চেষ্টা করলো। “বলেন কী, স্যার!”
“হুম,” আশেক মাহমুদ ডান হাতটা ডেস্কের উপরে রেখে তর্জনি দিয়ে টোকা দিতে শুরু করলো। এখন আমি যেটা বলবো সেটা আপনি বিশ্বাসই করতে চাইবেন না।”
আমাকে আর নতুন করে কী অবিশ্বাস্য গল্প শোনাবেন? মনে মনে বললো সে, কিন্তু মুখের অভিব্যক্তি একেবারেই ভিন্ন। “কী, স্যার?”
“বলবো, তার আগে এক কাপ চা-কফি হয়ে যাক।” আশেক মাহমুদ ইন্টারকমটা তুলে নিলো। “আপনি কি চা নেবেন নাকি কফি?”
সামনে থাকা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপের দিকে চট করে তাকিয়ে বললো নুরে ছফা, “কফি।”
.
অধ্যায় ৬
নুরে ছফার চোখেমুখে সত্যিকারের বিস্ময়ই ফুটে উঠেছে হাসিবের ক্ষমতাধর মামার কাছ থেকে মুশকান জুবেরির আন্দিজের প্লেন ক্র্যাশ আর ক্যানিবালিজমের কথা শোনার পর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই ক্ষমতাধর মানুষটি কী করে জানতে পারলো এটা, আর মুশকানের পুরনো ছবিটাই বা কী করে জোগাড় করলো-কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।
“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, স্যার।” নুরে ছফা নিজেই অবাক হলো, উপযুক্ত পরিস্থিতিতে পড়লে যে, সে-ও দারুণ অভিনয় করতে পারে সেটা বুঝতে পারছে আজ। তবে নিজের সৌভাগ্যকেই কৃতিত্ব দিচ্ছে সে। প্রথমে ভেবেছিলো, তার বলা মিথ্যেগুলো বুঝি ধরা পড়ে গেলো কিন্তু এখন অনেকটা নির্ভার লাগছে।
“আমি যখন প্রথম শুনলাম আমার অবস্থাও আপনার মতোই হয়েছিলো,” এবার সামনের দিকে ঝুঁকে এলো আশেক মাহমুদ। “বিশ্বাসই হতে চাইছিলো না। বিশেষ করে, মহিলা এতোগুলো বছর পরও কী করে নিজের বয়স ধরে রেখেছে!”
নুরে ছফা মাথা নেড়ে সায় দিলো। “সত্যি অবিশ্বাস্য!”
“শেক্সপিয়ার ঠিকই বলেছে, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন,” একটু থেমে আবার বললো, “কে বিশ্বাস করবে এসব কথা?!”
কেউ না, স্যার, মনে মনে বলে উঠলো ছফা। আর সেজন্যেই আমি আপনাকে এটা বলিনি। নিজের সিদ্ধান্তের পেছনে আরেকবার শক্তিশালী যুক্তিটা খুঁজে পেলো।
“এই মহিলা আস্ত একটা ডাইনি!” দাঁতে দাঁত পিষে বললো পিএস। “প্লেন ক্র্যাশের পর বাঁচার জন্য নরমাংস খেয়েছিলো, তারপর থেকে এর স্বাদ পেয়ে গেছে। পরবর্তীতে ক্যানিবালিজম প্র্যাকটিস শুরু করে! ভয়ঙ্কর ব্যাপার!”
ছফাও চোখেমুখে অবিশ্বাসের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলো। “আপনি এসব জানলেন কী করে, স্যার?” প্রশ্নটা না করে আর পারলো না।
চোখেমুখে আমুদে ভঙ্গি ফুটে উঠলো আশেক মাহমুদের। ক্ষমতাধরদের এমন ভঙ্গির সাথে ছফা বেশ পরিচিত-তোমাদের ধারণাও নেই আমার হাত কতো লম্বা-এরকম একটি ভঙ্গি থাকে তাতে।
“হাসিবের মা, আমার বড়বোন…” আস্তে করে বললো আশেক মাহমুদ। “…আপনি হয়তো জানেন না, আমার বুবুর ক্যান্সার ধরা পড়েছে। গত বছর।”
“ওহ্,” কথাটা শুনে সত্যি সত্যি দুঃখিত হলো ছফা। এততক্ষণ ধরে অভিনয় করে গেছে, এখন যেনো কয়েক মুহূর্তের জন্য সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বস্তি পাচ্ছে।
“আমার এই বোন যুদ্ধের পর পরই স্বামীর সাথে আমেরিকায় চলে যায়। ওখানেই ছিলো দীর্ঘদিন। হাসিব জন্ম নেবার পর বাকি সন্তানসহ তারা আবার চলে আসে দেশে। বুবুর বড় মেয়ে আর ছেলে পড়াশোনা করার জন্য কানাডায় চলে গেলেও হাসিব দেশেই থেকে যায়। আমার দুলাভাই আর বোনও দেশে ছিলো দীর্ঘদিন, কিন্তু দশ বছর আগে তারা চলে যায় তাদের বড় মেয়ের কাছে….কানাডায়।” একটু থেমে আবার বললো, “হাসিব তো বিয়ে-শাদি করেনি, একা থাকতো। বাবা-মাকে টেক কেয়ার করাটা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাদেরও বয়স হয়ে গেছিলো…দু জনেরই টেক কেয়ারের দরকার ছিলো।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গেলো একনিষ্ঠ শ্রোতা নুরে ছফা।
“হাসিব নিখোঁজ হবার দু-মাস পরই আমার দুলাভাই হার্ট ফেইলিওরে মারা যান,” একটু থেমে আবার বললো, “আর গত বছর বুবুর ক্যান্সার ধরা পড়ার পর যখন ডাক্তার জানিয়ে দিলো কোনো আশা নেই, টার্মিনাল স্টেজে আছে রোগটা, তখন বুবু এখানে চলে আসে। এখন উঠেছে আমার বাসায়।” একটু থেমে কফির কাপে চুমুক দিলো পিএস। “আমার ওয়াইফ আবার হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে গেস্ট লেকচারার হিসেবে কাজ করছে এক বছর ধরে, ফলে তাকে দেখাশোনা করার জন্য সার্বক্ষণিক নার্স রাখতে হয়। আমি তো সারা দিন ব্যস্ত থাকি…বুঝতেই পারছেন।” জবাবদিহি করার মতো শোনালো তার শেষ কথাটা।
আরো একবার মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। তবে সে ভালো করেই জানে, প্রধানমন্ত্রীর পিএস যা বললো তা পুরোপুরি সত্যি নয়। এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা বহু মানুষ নিজেদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে স্ত্রী-সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখনও চলছে সেই ধারা। এদের কর্মকাণ্ডের কারণেই কানাডার মন্ট্রিলের একটি এলাকার নাম হয়ে গেছে বেগমগঞ্জ-সব বেগমদের ঠিকানা! সন্তান-সন্ততি নিয়ে বেগমসাহেবারা উন্নত দেশে নিরাপদ জীবনযাপন করছে আর তৃতীয় বিশ্বের সমস্যাসঙ্কুল, দরিদ্র একটি দেশ লুটপাট করে, চুষে চুষে তাদের পতিদেবেরা স্ত্রী সন্তানদের জন্য স্বর্গীয় আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে-এই স্বর্গে স্বামীরাও যোগ দেবে, ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে কিংবা রক্ত খাওয়া শেষ হলে।