দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশেক মাহমুদ। আরেকবার আশ্বস্ত করার মতো সংবাদ শুনতে না পেয়ে হতাশই হলো। “যাই হোক, আপনি তো এতোদিনেও ঐ মহিলার কোনো ছবি জোগাড় করতে পারেননি?”
মাথা নেড়ে সায় দিতে বাধ্য হলো নুরে ছফা। আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি-মুশকান জুবেরির কোনো ছবি সে জোগাড় করতে পারেনি। যে হাসপাতালে সে কাজ করতো সেখানকার এম্প্রয়ি ফাইল থেকে সব কিছু গায়েব হয়ে যায় মহিলার অন্তর্ধানের পর পর। আর এ কাজটা যে মহিলার ডাক্তার বন্ধু এবং সহকর্মী আসকার ইবনে সায়িদ করেছেন সে-ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
“আমি তার ছবি জোগাড় করার অনেক চেষ্টা করেছি,” ছফা বললো। “কিন্তু মহিলা অনেক চতুর, সবখান থেকে নিজের ছবি সরিয়ে ফেলেছে। ছবি থাকলে কাজটা সহজ হতো অনেক।”
“হুম,” গম্ভীর হয়ে মাথা দোলালো একান্ত সচিব। “এ-ব্যাপারে আমার মনেও কোনো সন্দেহ নেই। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো সে। “আপনি বলেছিলেন মহিলা দেখতে বেশ আকর্ষণীয়…সুন্দরী…যেকোনো পুরুষকে কাবু করার মতো?”
“জি, স্যার।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো পিএস। তারপর ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটা এনভেলপ বের করে বাড়িয়ে দিলো ছফার দিকে। “এটা দেখুন।”
একটু অবাক হয়েই ছফা এনভেলপটা হাতে নিলো, খুলে দেখতেই মৃদু একটা ঝাঁকুনি খেলো সে। অবিশ্বাসে ভুরু কুঁচকে গেলো তার।
ছয় বাই দশ হবে। বেশ পুরনো হলেও ছবিটা সাদাকালো নয়-রঙ্গিন। সেই রঙ লালচে হয়ে গেছে।
“চিনতে পেরেছেন?”
আশেক মাহমুদের দিকে পলকহীন চোখে তাকালো নুরে ছফা। “এ এটা তো…” ঢোঁক গিললো সে। “…মুশকান জুবেরি!”
“মুশকান সোহেলি!” দাঁতে দাঁত পিষে বললো পিএস। “এটাই তার আসল নাম।”
ছফা স্থির চোখে চেয়ে রইলো কেবল।
এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে করে বললো আশেক মাহমুদ, “মাই গড! তাহলে বুবুর কথাই ঠিক!”
.
অধ্যায় ৫
দুনিয়াটা আসলেই ছোটো!
আশেক মাহমুদ মনে মনে বললো। নুরে ছফার হতভম্ব মুখটা দেখতে তার ভালোই লাগছে।
ছফার ডানহাতে বহুকাল আগের রঙ্গিন ছবিটি, সেই ছবি থেকে তার চোখ সরছেই না। অবিশ্বাসে তার কপালে পড়েছে ঘন ভাঁজ। চোখদুটো প্রায় স্থির, পলক পড়ছে বেশ ধীর গতিতে।
“ঐ মহিলা আমেরিকায় থাকার সময় ভোলা ছবি…কমপক্ষে চল্লিশ পাঁচচল্লিশ বছর আগেকার ছবি।”
ছফা বুঝতে পারলো সে বিপদে পড়ে গেছে। অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হতে লাগলো তার। দ্রুত খেলা করে গেলো কিছু ভাবনা। মুখ তুলে তাকালো সে। প্রধানমন্ত্রীর পিএসের মুখে বিজয়ীর হাসি।
“এ ছবি আপনি কোত্থেকে পেলেন, স্যার?”
“অনেক লম্বা গল্প,” বললো আশেক মাহমুদ। “তার আগে বলুন, আপনি এই মহিলা সম্পর্কে আর কী জানেন?”
ছফা নিজেকে ধাতস্থ করে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। দ্রুত ভেবে গেলো পরবর্তী কথাগুলো নিয়ে। সত্যিটা তাকে বিপদে ফেলে দেবে। আর মিথ্যেটা? সে জানে না। তার সামনে যে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বসে আছে সে মুশকান জুবেরি সম্পর্কে কতোটুকু জানে, তার কোনো ধারনাই নেই। এই ছবিটাই বা কোত্থেকে জোগাড় করেছে তা-ও বুঝতে পারছে না।
নুরে ছফার আরেকটু সময় দরকার-কী বলবে সেটা গুছিয়ে নেবার। জন্য। “আমি এই কেসটা তদন্ত করতে গিয়ে যতোটুকু জেনেছি সবটাই আপনাকে বলেছি।” অবশেষে নিজের বক্তব্যে স্থির থাকার সিদ্ধান্তই নিলো
সে। কোনো কিছু না-জানাটা দোষের হতে পারে কিন্তু অন্যায় নয়। তবে জেনেবুঝে কোনো কিছু লুকোনোটা ভীষণ অন্যায়-ছফা অবশেষে দুটোর মধ্যে প্রথমটাই বেছে নিলো।
“তাহলে আমি বলবো আপনি আসলে কিছুই জানেন না,” আয়েশ করে নিজের চেয়ারে হেলান দিলো আশেক মাহমুদ।
হাফ ছেড়ে বাঁচলো ছফা। ক্ষমতাধর মানুষেরা তাদের নীচের দিকে থাকা মানুষজনের অযোগ্যতা আর অক্ষমতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারলে এক ধরণের তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব এখন সেই ঢেঁকুর তুলছে।
“আপনার এই মুশকান জুবেরি-মানে, ডাক্তার মুশকান সোহেলি কোনো অগ্যান পাচারকারী কিংবা সিরিয়াল কিলার নয়,” ঘোষণা দেবার ভঙ্গিতে বললো আশেক মাহমুদ। “অবশ্য আপনার ধারণা পুরোপুরি মিথ্যেও নয়।” ক্ষমতাধর লোকটি বাঁকাহাসি দিলো। “তার কর্মকাণ্ড অনেকটা সিরিয়াল কিলারদের মতোই।”
ছফা আরেকটু আশার আলো দেখতে পেলো। উৎসুক হবার ভান করলো সে।
“আপনি তো তিন বছর আগে তাকে দেখেছেন, তখন তার বয়স কতত ছিলো?”
একটু ভেবে নিলো নুরে ছফা। তিন বছর আগে কী বলেছিলো মনে করার চেষ্টা করলো। মিথ্যে বলতে গেলে যে তুখোড় স্মৃতিশক্তির অধিকারী হতে হয় সেটা আরেকবার টের পেলো হাড়ে হাড়ে। “উমম…ত্রিশ-বত্রিশের মতো হবে?”
আশেক মাহমুদের ভুরু কপালে উঠে গেলো। “তাহলে আপনি অবাক হচ্ছেন না কেন?”
“মানে?” ছফা হুট করেই বলে ফেললো। পরক্ষণেই বুঝতে পেরে মনে মনে নিজেকে ভর্ৎসনা করলো সে। ধ্যাত্ব! এটা তার আগেই বোঝা উচিত ছিলো।
“জি, স্যার…মহিলার মধ্যে তো কোনো পরিবর্তনই দেখছি না?” একেবারে নিদোষ ভঙ্গিতে অবাক হবার ভান করে বললো। আমি তাকে তিন বছর আগে এরকমই দেখেছি…অথচ এই ছবিটা বেশ পুরনো!”
“পঁচাত্তুর সালের দিকে তোলা,” আশেক মাহমুদ জানালো তাকে। “প্রায় তেতাল্লিশ বছর আগেকার…ভাবতে পারেন??”
ছফা চোখেমুখে বিস্ময়ের ভাব আনার চেষ্টা করলো। এই প্রথম অভিনেতাদেরকে ঈর্ষা করলো মনে মনে। এর আগে তাদেরকে জোকার বলেই করুণা করতো। “মাই গড!” বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ানোর জন্য ইংরেজিতে বললো এবার। “এটা কী করে সম্ভব!?”