হর্ষ না বলে পারল না, কিন্তু নির্জন দুপুরে অভাগেদের যে বড় আনাগোনা বাড়ে, বীথি। আমার সম্পত্তি যে লুট হয়ে যাবে। বীথি বলল, তোমার লুঠ করার মত সম্পত্তি কীই বা থাকে ঘরে সবই তো থাকে লকারে। হর্ষ খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু লকারে যাকে রাখা যায় না, সেই যে আমার সেরা সম্পদ। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসায় হর্ষের কথাগুলি বীথি স্পষ্ট শুনতে পেল না।
কি বললে? চড়া গলাতেই প্রশ্ন করল বীথি।
হর্ষ বলল, সে কথা আর একদিন শুনো। আজ শুনে কাজ নেই।
.
৩.
একটি নির্জন দুপুর বীথি বড় সুখে কাটাচ্ছিল। অবশ্য একা নয়, আর একজনের সঙ্গে। সেই আর একজন হর্ষের কাছে অভাগার হলেও বীথির কাছে বড়ই বাঞ্ছিত জন।
সেই দুপুরে হর্ষ অফিসের কাজে মন বসাতে পারছিল না। অর্ধদিবস ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর বাস ধরে ফিরছিল নিজের আস্তানার দিকে। নামার স্টপ ক্রমে এগিয়ে আসছিল। সিট ছেড়ে উঠবে উঠবে ভাবছে, এমন সময়ে বাসের জানালা দিয়ে সহসা তার চোখে পড়ল, একটি মঞ্চের দিকে মৌলিকে নিয়ে পারুল এগোচ্ছে। সেখানে ম্যাজিক দেখানো হবে।
হর্ষের বুকটা দ্যাৎ করে উঠল। মৌলি ম্যাজিক দেখবে, পারুলও ম্যাজিক দেখবে, সেকথা ঠিক। কিন্তু নিজের আস্তানায় গিয়ে সে কি দেখবে? যা দেখবে, তারপর নিজেকে স্থির রাখতে পারবে তো?
হর্ষ বাস থেকে নামল। ততক্ষণে মৌলিকে নিয়ে পারুল মঞ্চে ঢুকে গেছে। হর্ষ তাদের পিছু না নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দিকেই এগিয়ে চলল।
কোলাপসিবেল গেটে তালা ঝুলছিল ভেত্র থেকে। তার অর্থ, ভেতরে কেউ আছে। হর্ষ লু কলিং বেল না বাজিয়ে গেটের তালাটা ঘুরিয়ে দিয়ে নিজের কাছে রাখা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে খুলে ফেলল। তারপর গেটটা দুদিকে সরিয়ে দিয়ে দরজার হাতলে চাপ দিল। দরজা তালাবদ্ধ না থাকা খুলে গেল। হর্ষ নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকল। জুতো মোজা খুলে যথাস্থানে রেখে সে নিজের শয়নকক্ষের দিকে এগিয়ে চলল।
বীথির হাসি যেন গলিত লাভার মত তাকে স্পর্শ করল। শয়নকক্ষও অর্গল বদ্ধ ছিল না। তাই হাতের সামান্য ঠেলাতেই দরজা উন্মুক্ত হল।
সেখানে হর্ষ থাক দেখুক, বীথি কিন্তু ভূত দেখার মত চমকে উঠল না।
আর বীথির বান্ধবটিও চোরের মত নিঃশব্দে পলায়ন করল না।
সে তার পোশাক আশাক নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।
বীথি তার স্বামীর সামনেই বেশ বাস পরে নিল, যা তার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। হর্ষের দুই চোখে ক্রোধ বহ্নি জ্বলে উঠলেও তা স্থায়ী হল না। তাতে বর্ষার সজলতাই পরিস্ফুট হয়ে উঠল।
বীথির বান্ধবটি বাথরুম থেকে পোশাক পরে বেরিয়ে এসে বলল, তোমার হাজব্যান্ড যখন চলেই এসেছেন, আমি তাহলে আজ চলি।
হ্যাঁ, এস।
সে চলে যেতেই বীথি হর্ষকে বলল, খুব ব্যথা দিলাম, মনে হচ্ছে? কিন্তু তোমার মত আধুনিক যুবক এ ব্যাপারে কেন ব্যথা পাবে, সেটাই তো বুঝি না। তুমি কি জানো না, প্রতি মানুষই পৃথিবীতে একবার জন্মায়? সেই একবারের জন্মকে সার্থক করতে হয় পরিতৃপ্তির মাধ্যমে? আমি পরিতৃপ্ত। তাই আমার জন্ম সার্থক।
হর্ষ গম্ভীর স্বরে বলল, এবার বুঝলাম, কেন তোমার এমন একটি আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিল।
বীথি বলল, ঠিকই বুঝেছ। এর জন্য আমি লজ্জিতও নই। পরাক্রান্ত পুরুষেরাই কেবল বসুন্ধরাকে ভোগ করবে কেন? নারীরাও যে পারে, আজ তা দেখিয়ে দেওয়ার দিন এসেছে।
এইভাবে? সংসারের ইজ্জৎ লুণ্ঠিত হতে দিয়ে? আমি তা মানতে পারছি না, বীথি। তাই ঠিক করে ফেললাম, আজই আমি মৌলিকে নিয়ে আমার বাবা-মায়ের কাছে চলে যাব। তবে তোমাকে আমি নিরাশ্রয় করে যাব না। আমাকে দেওয়া কোম্পানির ফ্ল্যাট তোমারই থাকবে। বিয়ের মন্ত্র তুমিও উচ্চারণ করেছিলে, বীথি। তবু তুমি তার মূল্য দাও নি।
অগ্নিকে সাক্ষী রেখে শালগ্রাম শিলার সামনে আমি তোমার খাওয়া, পরা ও থাকার ভার নেওয়ার শপথ নিয়ে ছিলাম, সে-শপথ আমি ভাঙি কি করে, বল?
কথাগুলো বলতে বলতে হর্ষ তাদের শয়নকক্ষ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল।
বীথি বলে উঠল, শোনো। তোমার গার্লফ্রেন্ড যদি না থাকে তো কলগার্লদের নিয়েও ফুর্তি করতে পার। আমি আপত্তি করব না।
তবু হর্ষ আর ফিরে তাকাল না।
হয়তো পরে ফিরবে মৌলিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।