- বইয়ের নামঃ অলোককৃষ্ণ চক্রবর্তীর গল্প
- লেখকের নামঃ অলোককৃষ্ণ চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
ভুবন চৌধুরী – অলোককৃষ্ণ চক্রবর্তী
সেদিন থেকে ভুবন চৌধুরীর নিজের ভুবনটা চিরদিনের মতন অন্ধকারে ডুবে গেল। তারপর সত্যি সেই সদানন্দ মানুষটির মুখে আর কোনদিন কেউ হাসি দেখতে পায়নি। দেখতে পায়নি তাকে আনন্দে-খুশিতে ভরা তার সেই সাধের অফিসেও। এমন কি দেখা যেত না কোন অনুষ্ঠানে পর্যন্ত। ব্যাপারটা সত্যি অদ্ভুত।
ম্যারেজ-রেজিস্ট্রার ভুবন চৌধুরীর খুবই নামডাক। জনপ্রিয়তাও কম নয়। সবার মুখেই তার দরাজ ও দরদি মনের প্রশংসা।
নিয়মিত স্নান সেরে বেলা দশটায় একতলার ড্রইংরুমে এসে বসেন ভুবনবাবু। থাকেন রাত আটটা পর্যন্ত। মাঝে দুঘন্টার বিরতি। বেলা একটা থেকে দুটো লাঞ্চ। আর সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে ছটা সান্ধ্যভ্রমণ। ভ্রমণের সময় অবশ্য স্ত্রী বিজয়া থাকেন সঙ্গে। বাঁধা রুটিন। কোন পরিবর্তন নেই। এমন কি ছুটিছাটার দিনেও এই রুটিন বাঁধা নিয়মে চলেন ভুবনবাবু। বিয়ের বছর পাঁচেক পর থেকে এই নিয়ম চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
নিজের বাড়ির ড্রইংরুমটাই ভুবনবাবুর অফিস। অর্থাৎ ম্যারেজ রেজেস্ট্রি অফিস। বেশ বড় ঘর। ঝকঝকে, তকতকে। সুন্দর আসবাবপত্রে সাজানো। কার্পেট, পর্দা, টেলিফোন, টাইপ মেসিন—সবই আছে। সবই রুচিসম্মত। এককথায় ঘরটি শোভন এবং শৌখিন, দুই-ই। বাড়িটিও দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত অঞ্চলে।
ঘরের পুব দিকের জানলার ধারে বসেন ভুবনবাবু নিজে। অফিসকর্মীরা বসে পশ্চিম দিকে। অফিসকর্মীরা মানে একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। উত্তর দিকের দরজার পাশে পরপর তিনটে আলমারিতে সারি সারি বই। কিছু আইনের বই। বাকি সব গল্প-উপন্যাসধর্মগ্রন্থ। দক্ষিণ দিকে চারটে জানলা আর একটা দরজা। ঐ দিকটা পুরো খালি ও খোলা। সামনে শুধু বারান্দা।
ভুবনবাবুর কাছে অফিস-ঘরের আকর্ষণই আলাদা। এটাই তার নিজস্ব জগৎ। হাসিখুশিতে টইটম্বুর হয়ে থাকেন তিনি এখানে। এই জগতের মধ্যেই ডুবে আছেন গত পচিশ বছর ধরে। আহারে-বিহারে, শয়নে-স্বপনে প্রতিক্ষণই এই জগতের কথা তার মনে। কত বিচিত্র মানুষের আনাগোনা এখানে। এই সব মানুষ নিয়েই ভুবনবাবুর কারবার।
এদের মধ্যে কেউ আসে চুপিসাড়ে দুরুদুরু বক্ষে অভিভাবকের চোখে ধুলো দেয়—আবার কেউ আসে রীতিমত ঘটা করে। এরা সবাই আসে ঘর বাঁধতে। অনেকে আবার আসে বিয়ের পরও। কেউ আসে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করতে। কেউ কেউ আবার দ্বািদ-বিরোধ মেটাবার জন্য।
বাদ-বিসংবাদ মেটানো ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাজ না হলেও ভুনববাবু কিন্তু সেটা খুশি মনে করেন স্বেচ্ছায়, বিনা পয়সায়। তাঁর মতে এর চেয়ে মহৎ কাজ এ দুনিয়ায় আর কি হতে পারে। বিচ্ছেদের মুখে দুটি জীবনকে মিলে সহায়তা করা, একটা সুন্দর সংসারকে ভাঙ্গার মুখে রক্ষা ভুবনবাবুর কাছে বড় পুণ্যের কাজ। বিয়েতে দুটি জীবনকে এক ছন্দে গেঁথে দিয়ে তিনি যে আনন্দ পান, তার চেয়ে ঢের বেশি তৃপ্তি পান ছন্দ হারানো জীবনকে আবার নতুন ছন্দে সাজিয়ে দিতে। তাই ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ভুবন চৌধুরী মক্কেলদের কাছে যেমন প্রিয় তেমনি তাদের আপনজন।
বিয়ের সময় ভুবনবাবুর আন্তরিকতার স্পর্শে মুগ্ধ হয় নব দম্পতি থেকে উপস্থিত সবাই। ঠিক যেন একজন অভিভাবক—নব দম্পতির এবং উপস্থিত সকলের। নানা উপদেশ দেন তিনি সবাইকে। মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনে সবাই। বিশেষ করে নব দম্পতির মনে গেঁথে থাকে তার উপদেশবাণী। সুখে-দুঃখে, সম্পদে-বিপদে তিনি যে তাদের পাশে আছেন—এ কথাটা বুঝতে কারো অসুবিধে হয় না। তাই তো তারা কোন সমস্যায় পড়লেই চট করে ছুটে আসে ভুবনবাবুর কাছে।
প্রায় সব সময়ই ভুবনবাবু মক্কেলদের নিয়ে আমেজে আবেগে আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকেন। সকলের আনন্দে-হাসিতে অফিস ঘরখানাও যেন হেসে থাকে সারাক্ষণ।
এই নিজস্ব জগৎটা নিয়ে দিব্যি ছিলেন ভুবনবাবু। সংসারের কোন সাতে-পাঁচে থাকলে না। সেদিকের সব দায়িত্ব স্ত্রী বিজয়ার ওপর। কিন্তু হঠাৎ সেদিন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত অপ্রত্যাশিত ঘটনায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। সে এক করুণ কাহিনী। সেকথা এখানে নয়, যথাস্থানে। এখন ভুবন চৌধুরীর সংসারের দিকে আসা যাক।
ভারি চমৎকার একটি সংসার। বছর খানেক হল মেয়ে রত্নার বিয়ে হয়েছে। ঘর বর দুই-ই ভাল। সত্যি গর্ব করার মত জামাই। বড় বংশের স্বাস্থ্যবান শিক্ষিত সুদর্শন ছেলে। রূপে-গুণে তার জুড়ি মেলা ভার। বিদেশের ডিগ্রিপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার। বড় পোস্ট, মোটা মাইনে। মেয়েও অবশ্য কম যায়না। ফিলজফিতে এম.এ.। স্পষ্টভাষিণী, আদর্শবাদী। প্রফেসারি করছে কলকাতার একটা নামকরা কলেজে। আর তার রূপ। তিলোত্তমাও বুঝি হার মেনে যায়। ছেলে পার্থ এখনো পড়াশোনা করছে। পড়ছে প্রেসিডেন্সি কলেজে। যেমন মেধাবী তেমনি ভদ্র। আজকালকার ছেলেদের মত নয়। আর স্ত্রী বিজয়া! ঘরে লক্ষ্মী বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও দারুণ। কিন্তু হঠাৎই সেদিন অম্লমধুর বাক্য বিনিময় হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। অতীতের যে কথা কাটাকাটি হয়নি তা নয়, কিন্তু সেটা ঠিক এই পর্যায়ে পৌঁছায়নি কখননা। সত্যি, সংসারে কখন যে কি থেকে কি হয় বলা মুশকিল।