হর্ষ চলে এল সে-ঘরে, যে ঘরে মৌলিকে নিয়ে কাজের বৌটি ঘুমায়।
আয়নার সামনে মৌলিকে সে একাই দেখল। অপটু হাতে নিজের সাজ নিজেই করছে।
হর্ষ জিজ্ঞেস করল, তোর পারুল মাসি কোথায়?
মৌলি বলল, আমিও অনেকক্ষণ দেখছি না। ও আমাকে ঠিকমত সাজাতে পারে, বাপি, তুমি ঠাকুরমাকে এখানে নিয়ে এস।
তোর মা যদি সাজিয়ে দেয়, রাজি তো? হর্ষ মেয়ের চোখে চোখে তাকাল।
মৌলি বলল, না, বাপি। মা কোনও দিন আমার চুলও আঁচড়ে দেয়নি। আমার ব্যাপারে মাকে তুমি কিছু বোলো না। ঠাকুরমার হাতে সাজতেই আমার সবচেয়ে ভাল লাগত। তারপর ঠাকুরদা যখন আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে যেত, মনেই হত না, আমি পথে হাঁটছি। সুন্দর সুন্দর গল্প শুনতে শুনতেই সময় কেটে যেত। বাপি, তোমরা যখন আমাকে তোমাদের কাছে নিচ্ছ না, আমাকেই রং ঠাকুরমা ঠাকুরদার কাছে পাঠিয়ে দাও। সেখানেই আমি ভাল থাকব।
মেয়ের কথা শুনতে শুনতে হর্ষের বুক ব্যথায় যেন ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল। কোনও রকমে চোখের জল সামাল নিয়ে সে বলল, মৌলি, সবুর কর। আমিই তোকে সাজিয়ে দেব। তারপর স্কুলেও পৌঁছে দিয়ে আসব। তোকে বলার জন্য কত গল্পই না আমার মনে জমা হয়ে আছে রে।
মৌলি তার বাপির মুখের দিকে তাকাল একবার। তারপর হঠাৎই বলে উঠল,, বাপি, তুমি কখনও ঠাকুরদার মত গল্প বলতে পারবে না। তোমাকে দেখলেই আমার মনে হয়, তুমি শুধু হিসেব কষছ। তুমি কি করে আমাকে আনন্দ দেবে? ঠাকুরদা ঠাকুরমাকে রেখে যখনই এখানে চলে এলে, তখন থেকেই আমার মুখে আর হাসি আসে না, গলাতেও গান আসে না, বাপি। শুধু মাকে বড় হাসিখুশি দেখি। দুপুরে যখন মামা কাকারা আসে, মায়ের সে কী হাসি!
হর্ষ যেন তড়িতাহত হল। তার অনুপস্থিতিতে নির্জন দুপুরে নিজেদের শয়নকক্ষে বীথি তাহলে পুরুষ সঙ্গ করে!
মেয়েকে সে প্রশ্ন করল, মামা কাকারা তোকে আদর করে তো, মৌলি?
মৌলি বলল, আমি তাদের কাছে কখনও যাই না, বাপি। স্কুল থেকে ফিরেও আমাকে এইঘরেই থাকতে হয়। উঁকি ঝুঁকি দেওয়াও মা পছন্দ করে না। জোর ধমক দেয়। আজকাল দরজাই বন্ধ করে রাখে। আমি শুধু আওয়াজ শুনে বুঝি, কত আনন্দই না করছে। আমার কেবলই কান্না আসে, বাপি।
হুম। অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় ভেঙে পড়া হর্ষের মুখ থেকে আর কোনও শব্দ বের হল না।
সেসময়ে কাজের বৌটি এসে বলল, আপনি সরুন, দাদা। মৌলিকে আমি ঠিক সময়েই স্কুলে পৌঁছে দিতে পারব। ও আজকাল বেশ জোরেই হাঁটতে পারে।
হর্ষ গম্ভীর স্বরে বলল, তুমি দেরি করবে আর মৌলিকে জোরে হাঁটাবে, এটা ঠিক নয়, পারুল। এ সময়ে গিয়েছিলে কোথায়!
পারুল মৌলির চুল আঁচড়ে দিতে দিতে বলল, একজন কাজে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে গেল। সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম।
কে সে? তোমার স্বামী?
না, দাদা। সে আমার স্বামীর বন্ধু। যতবলি, এখন ব্যস্ত আছি, সে তবু ছাড়তে চায় না। পর পুরুষগুলি একেবারে জোঁকের মত। বিরক্তি ধরে গেলে সে কথাই ভাবতে হয়। তা না হলে অবশ্য আনন্দের সঙ্গীও হয়ে ওঠে। যেমন ধরুন, বৌদির বন্ধুরা তার আনন্দের সঙ্গী। সেঁক নয়। তাই তো অমন হাসিঠাট্টা চলে। আমি কিন্তু আমার স্বামীর বন্ধুকে ঝামটা মেরে চলে এসেছি।
তাই তো আসবে। তুমি পরের বাড়িতে কাজ কর, লোকটা তা চিন্তা করবে না কেন? হর্ষ তার বক্তব্য ব্যক্ত করে পুনরায় বলল, পারুলের কি দুপুরে ঘুম হয় না?
পারুল বলল, দুপুরে ঘুমের অভ্যাস আমার নেই, দাদা। বৌদি তাই মাঝে মাঝেই দুপুরে আমাকে সিনেমা দেখতে পাঠায়। যতবলি, আজকাল টিভির সামনে এত বসি যে, হলে বসতে আর ইচ্ছে হয় না, বৌদি সেকথা শুনতেই চায় না। তবে আমি বেরিয়ে গিয়ে সব সময়েই যে হলে বসি, তা নয়। আমার স্বামীর কাজের জায়গায় গিয়ে মাঝে মাঝেই তাকে সাহায্য করি।
আর মৌলি তার ঘরে একা পড়ে থাকে! হর্ষের কণ্ঠস্বরে যেন মেঘের মৃদু গর্জন।
পারুল বলল, একা পড়ে থাকলেও লেখাপড়াই করে, দাদা। আপনার মেয়েটি কিন্তু খুবই ভাল।
কথা বলতে বলতেই পারুল মৌলির যাবতীয় কাজ শেষ করে তাকে নিয়ে দ্রুত পা বাড়াল। হর্ষ বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে দেখল, পারুল সে ভাবে মৌলিকে নিয়ে। স্কুলের দিকে ছুটছে, তাতে মৌলির নরম পায়ের যথেষ্টই ক্ষতি হতে পারে।
শরীরের আলস্য ঝাড়তে ঝাড়তে বীথি এসে দাঁড়াল হর্ষের পাশে। কি এত কথা বলছিল পারুল তোমাকে?
হর্ষ বলল, সে অনেক কথা। তারপর থেকে ভাবছি, এ ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে আবার বাবা মায়ের কাছে গিয়েই থাকব। মৌলিও তাতে ভাল থাকবে। আমাকে সে বলেছে।
বীথি যেন জ্বলে উঠে বলল, আমারও তা ভাল লাগবে কিনা, তা জিজ্ঞেস করারও বুঝি প্রয়োজন বোধ করছ না?
হর্ষ বলল, তিনজনের মধ্যে দুজন মত দিলে তা অনুমোদিত হয়ে যায়, বীথি। তোমার ভাল না লাগলেও ভাল লাগাতে হবে। এছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
বীথি হঠাৎ রুক্ষস্বরেই বলল, বাপ মেয়ে থাক গিয়ে সেখানে। আমি কিন্তু এখান থেকে নড়ছি না।
বীথির চোখে চোখে তাকিয়ে হর্ষ বলল, এতই তোমার এখানে থাকার ইচ্ছে?
বীথি বলল, হ্যাঁ। জীবন বড় ছোট। স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিলে এ জীবনে নিজের খুশিমত ব্যয় করার জন্য আর সময় পাওয়া যাবে না। নিজের জন্য যে সময় আমি কেড়ে নিতে চাই, তাতে আর কারও বাধা আমার সহ্য হবে না, এমন কী মৌলির বাধাও না। আমি এ-ও ভেবে নিয়েছি। মৌলি এখানে থাকলে আগামী শিক্ষা বর্ষে সে দুপুরের স্কুলেই পড়বে। পারুলকেও সব সময়ের জন্য রাখার প্রয়োজন হবে না।