প্রতিদিনের মতো ঘরে ধুনো দিল তিলু। মশারী টাঙিয়ে পরানকে ঘুম পাড়াল। শেষ খেপ জল আনার সময় পরান বলেছিল, জ্যাঠাই, বড় হয়ে আমি তোকে লিয়ে যাব মামাদের গাঁয়ে। পরান, ছেলেটা বড় বেঁধে রেখেছে তিলুকে। বোধ হয় বেঁচে থাকা এর জন্যেই। আরও একটা ক্ষীণ স্রোত অন্তরীক্ষে, যদি সে মানুষটা ফেরে। কেউ বলে, সে সন্ন্যাস নিয়েছে। পালেদের জামাই তারকেশ্বরে পুজো দিতে গিয়ে দেখেছিল তাকে। কেউ রটায় সে চাপাডাঙায় মেয়েছেলে রেখেছে।
রাত বাড়ছে। সবার খাওয়া শেষে তিলু ঘাটে গেল। হাঁড়িতোলা রাত ভারী হবে এবার। তিলুর খাবার ইচ্ছে নেই। না খেলে শাশুড়ীর গালমন্দ, চোটপাট মারধর। লুকিয়ে জামবাটির তলার সমস্ত ভাত ফেলে দিল জলে। হাঁসে খাবে, মাছে খাবে। সবাই তো বেঁচে থাকবে। ঘরে ফিরে থালা রাখল। রান্না ঘর মুছল তিলু। চুপিসাড়ে দরজার পাশে গিয়ে শুনতে চাইল দেওরের ঘুমের গভীরতা কতখানি।
শাশুড়ীর পানের ডিবের শব্দ আসছে। চৌকিদারের হাঁক, ‘হো-হো-হো-হো-ও’ রাতের গভীরতায় ডুবে যাচ্ছে সবকিছু। উঠোনে জাম গাছের ছায়া কখনও পড়ছে, কখনও হারাচ্ছে, আগাম বর্ষার আলো-ছায়ার খেলা। শোবার ঘরে ধুনোর আগুন সামান্য উসকে দিয়ে মশারীর মধ্যে গেল। পরান ঘুমিয়ে কাদা।
কাল সকালে পরান কাদবে, কত কাদবে। শাশুড়ী এতদিন যা চাইত, যা খুলে মেলে বলত তাই ঘটেছে দেখে খুশী হবে। দেওর আর জায়ে কাল সকালে বা পরশু হাত-পা ছড়িয়ে সম্পত্তির হিসেব করবে। তারপর আবার সবাই ভুলে যাবে।
ধুনো-চুরে আরও কিছুটা ধুনো দিল তিলু। চুপি সাড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। যেন গোয়াল দেখাতে যাচ্ছে। গরুটার শিঙের ব্যথাটা কমবে একদিন। ওকে মাঠ দেখানো হবে। ওর বাচ্চা হবে। সব ঠিক থাকবে, থাকবে না শুধু যার ধন সে।
লাছ দুয়ারে হুড়কো খুলল তিলু। বাইরে এল। ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করল। ঘুর পথে হাঁটতে শুরু করল। এত রাতে কেউ বের হবে না। যারা এত রাতে বের হয় তারা কেউ জানবে না। হাঁটবেও না এই ঘুর পথে।
এই পথ সোজা কুয়োতলা। সেখান থেকে মাঠ ভেঙে, তারপর…। তিলু জানে না। সব পথ ভূষণের শিকড়ের থলিতে। ভয় লাগছে। আকাশে উড়ো মেঘেরা অন্ধকার সাজিয়েছে। এই অন্ধকার এখন বড় জরুরি, বড় দরকার।
তিলু হাঁটছে। কুয়োতলায় যখন এল শুনতে পেল পুকুর পাড় থেকে ভূষণ গলার শব্দ করল। আচ্ছা যদি কেউ ভূষণকে দেখে? পুরুষ মানুষের সাতখুন মাফ। আর মেয়েমানুষের বদনামটাই সম্বল। তাই নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। মেয়েমানুষ বড় কাঙাল। এইবার তিলুর মধ্যে সংশয়ের ঢেউ। তবুও গেল পুকুর পাড় ধরে। আকাশ থেকে মেঘ সরে যাচ্ছ। ভূষণের বুকের মধ্যে যা ভয় জমছে তিলুর তার একশো গুণ।
ভূষণ বলল ফিস ফিস করে, খুব কাছেই তিলু। চলো এই মাঠ-পথ অনেক সহজ।
তিলু মুখ তুলল। ভূষণ গাছের শিকড়ের গন্ধ চেনে। মেয়েদের শরীরের এই গন্ধ সে কোনোদিন পায়নি। এখানে কোন শিকড় আছে? শ্বেতকরবী না তেসিরে মনসার আঠা! নাকি, রাঙা জবার ডাল। ভূষণ পাগলপারা। তিলুর মাথা ঘুরছে। ঘরের ধুনোর গন্ধ, পরানের হাত পা ছড়ানো শরীর। উঠোনের উপর জামের গাছের ছায়া। আর গাঁয়ের সব মেয়েদের হাতে যে বিশ্বাস তুলে দিয়েছিল তিলু!
তিলু হাত ছাড়িয়ে নেয়। তুমি যাও।
চৌকিদারের হাঁক কাছে আসছে। দ্রুত পায়ে তিলু কুয়োতলার কাছে ফিরে আসে। ভূষণকে দেখার চেষ্টা করল। একি ভূষণ মাঠ পার হয়ে সোজা পথ ধরেছে। ধরুক। সামনে চৌকিদারকে দেখে তিলু ভূত দেখলে। কে গো? উত্তর নেই। কাছে এল চৌকিদার। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল কী গো মা, এত রাতে? তিলু পীরের থান দেখিয়ে বলল, মাটি আনতে।
সোজা পথেই তিলু ফিরল। শুধু ভাবল, এক আঁধার কাটানোর জন্যে আর এক আঁধারে কেন ডোবা, ডুব দেওয়া। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, এই জ্যোৎস্নায় আলোকিত পথে ওর ঝাঁপজল বলছে, সয়ে থাকলে রয়ে পাবি ঝাঁপজল। আর ওর বুকের মধ্যে পরানের হাত। মাথার মধ্যে ধুনোর গন্ধ। ও ঘরে ফিরে এল।